রাজনীতি বিজ্ঞানের অনুশীলনে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল ধারণা
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Behavioralism) রাজনীতি বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, যা ১৯৫০ এবং ১৯৬০ দশকে জনপ্রিয় হয়। এর মূল ভিত্তি হলো রাজনীতির বিশ্লেষণ, যেখানে ব্যক্তি এবং দলের আচরণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। আচরণবাদীরা মনে করেন যে, রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যয়নের সময় গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ব্যক্তি, দল, এবং প্রতিষ্ঠানের আচরণের পর্যালোচনা করা। তারা নীতি-নৈতিকতা বা আদর্শের উপর নির্ভর না করে, রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যকরী দিকগুলি বিশ্লেষণ করার উপর গুরুত্ব দেন।
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উত্থান ও বিকাশ
১৯৪০ ও ১৯৫০ এর দশকে আমেরিকার রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা ঐতিহ্যগত রাজনীতি বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করেন। তারা লক্ষ্য করেন যে, শুধুমাত্র সাংবিধানিক কাঠামো বা প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্লেষণ রাজনীতির প্রকৃত চিত্র প্রদানে সক্ষম নয়। এই সীমাবদ্ধতাগুলো থেকে মুক্তি পেতে নতুন গবেষণা পদ্ধতির প্রয়োজন দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উত্থান ঘটে। আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যক্তির আচরণকে প্রথম স্থানে রাখে এবং বিভিন্ন মনোবিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান পদ্ধতিগুলোর সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে।
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য
১. উপলব্ধি এবং পরিমাপযোগ্যতা:
আচরণবাদী গবেষকরা মনে করেন যে, শুধু বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিমাপযোগ্য আচরণই গবেষণার জন্য গ্রহণযোগ্য। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের যথাযথ পরিমাপ এবং উপলব্ধির জন্য তারা সংখ্যাতাত্ত্বিক (quantitative) এবং পরিমাণগত (qualitative) পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেন।
২. উদ্দেশ্যমূলক বিশ্লেষণ:
আচরণবাদী পদ্ধতি প্রধানত বাস্তব ও উদ্দেশ্যমূলক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেয়। এতে আদর্শ বা মূল্যবোধের ওপর নির্ভর না করে রাজনৈতিক বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করা হয়।
৩. বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি:
আচরণবাদীরা গবেষণার সময় নির্দিষ্ট মডেল বা তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে, রাজনৈতিক বাস্তবতার গভীর বিশ্লেষণ করেন। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, নির্বাচন, নেতার মনোভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি।
৪. পরিসংখ্যান এবং গাণিতিক পদ্ধতি:
আচরণবাদীরা তাদের গবেষণার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান এবং গাণিতিক মডেলগুলো ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং আচরণের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হন।
৫. সামাজিক বিজ্ঞান পদ্ধতির প্রয়োগ:
আচরণবাদীরা মনে করেন যে, রাজনীতি বিজ্ঞানকে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, এবং অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত করে গবেষণা করা উচিত। এর ফলে, রাজনৈতিক আচরণের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ সম্ভব হয়।
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উপযোগিতা এবং প্রভাব
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ও উপযোগিতা রয়েছে:
১. গভীর বিশ্লেষণ:
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিশদ বিশ্লেষণ করতে সহায়ক। এটি রাজনীতির কেবল মাত্রাতিরিক্ত ধারণার বাইরে গিয়ে বাস্তব দিকগুলোর উপর নজর দেয়।
২. পরিমাপযোগ্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ:
আচরণবাদী পদ্ধতির মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যগুলো সংখ্যায় পরিমাপযোগ্য হওয়ায়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি তথ্যভিত্তিক এবং বৈজ্ঞানিক হয়।
৩. প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্য:
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতি বিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো একটি বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এতে রাজনীতির অধ্যয়ন আরও প্রমাণভিত্তিক এবং পূর্বানুমানযোগ্য হয়ে উঠেছে।
৪. নতুন গবেষণা ক্ষেত্র:
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে, রাজনীতি বিজ্ঞানে অনেক নতুন গবেষণা ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচন আচরণ, রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞান, এবং নীতি বিশ্লেষণ।
৫. অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি:
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের উপর আলোকপাত করেছে। এটি রাজনৈতিক প্রচারণা এবং জনমতের উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা
যদিও আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতি বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তবে এটি কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে আসতে পারে:
১. মানবিক মূল্যবোধের অবহেলা:
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক আচরণের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়। তবে এতে মানবিক মূল্যবোধ, নীতি, আদর্শ, এবং নৈতিকতা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়।
২. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গের অবহেলা:
আচরণবাদী গবেষণায় অনেক সময় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং ঐতিহাসিক প্রসঙ্গগুলো অবহেলিত হয়। এই প্রসঙ্গগুলো রাজনীতির বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৩. মানুষের আচরণের জটিলতা:
মানুষের আচরণ এবং মনোভাব অত্যন্ত জটিল এবং পূর্বাভাসযোগ্য নয়। আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এই জটিলতাগুলো সম্পূর্ণরূপে ধরা দেয় না।
৪. রাজনৈতিক ঘটনাবলীর পূর্বাভাস:
আচরণবাদী মডেলগুলো কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর যথাযথ পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হতে পারে, বিশেষ করে যদি সেই ঘটনা আচরণবাদী পদ্ধতির বাইরে থাকে।
উপসংহার
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতি বিজ্ঞানে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। এটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণের একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে, যেখানে ব্যক্তির আচরণ, তথ্যের পরিমাপযোগ্যতা, এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে এটি এখনও রাজনীতি বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী পদ্ধতি।
এটি নিশ্চিত করেছে যে রাজনীতি বিজ্ঞান কেবলমাত্র ঐতিহাসিক এবং সাংবিধানিক বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশীল না থেকে, বৈজ্ঞানিকভাবে পরিমাপযোগ্য এবং প্রমাণভিত্তিক একটি শৃঙ্খলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।