হষাঙ্ক বংশের আমলে বিশেষ করে বিম্বিসার ও অজাতশত্ৰু নেতৃত্বে কিভাবে মগদে উত্থান ঘটে তা আলোচনা কর।

হষাঙ্ক বংশের আমলে বিশেষ করে বিম্বিসার ও অজাতশত্ৰু নেতৃত্বে কিভাবে মগদে উত্থান

হর্যঙ্ক বংশের পরবর্তী শাসক অজাত শত্রু ছিলেন বিম্বিসারের দ্বিতীয়া স্ত্রী লিচ্ছবি রাজকন্যা চেতনার গর্ভজাত সন্তান। বিম্বিসারের শাসন কালে অজাতশত্রু চম্পার শাসক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। মগধের সিংহাসনে আরোহন করার জন্য অধৈর্য হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত বিম্বিসার কে হত্যা করে সিংহাসনে বসে ছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতে। যেভাবেই তিনি সিংহাসনে আরোহন করুন না কেন, পিতার সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের নীতিকে তিনি অবশ্য অব্যাহত রেখেছিলেন। এদিক থেকে প্রাশিয়ার শাসক দ্বিতীয় ফ্রেডারিক এর সঙ্গে তাকে তুলনা করা চলে। কেননা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক ও অজাতশত্রু উভয়ের সঙ্গেই তাদের পিতাদের সম্পর্ক ছিল খুবই তিক্ততর, অথচ তাদের শাসনকালে উভয়েই তাঁদের পিতার নীতি অনুসরণ করেছিলেন। একদিক থেকে পিতা বিম্বিসার ও পুত্র অজাতশত্রু মধ্যে মিল ছিল। কারণ উভয় চেয়ে ছিলেন একটা বৃহত্তর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটাতে। তবে বিম্বিসারের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের যে পরিধি ছিল তাকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন অজাত শত্রু। তার সময়ও মগধের রাজধানী ছিল রাজগৃহ। চারিদিকে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত এই শহরটি ছিল বেশ সুরক্ষিত। এক কথায় তিনি যে কেবল বিম্বিসারের যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন তাই নয়, তার সময় এই হর্যঙ্ক বংশের গৌরব ও প্রভাব প্রতিপত্তি এর উচ্চসীমা স্পর্শ করেছিল।

সিংহাসন লাভের কিছুকাল পরেই অজাত শত্রু কোশল রাজ প্রসেনজিতের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। মগধের সঙ্গে কোশলের এই যুদ্ধের কারণ ছিল অজাত শত্রু কর্তৃক বিম্বিসার কে হত্যা করা। এর ফলে কোশলরাজ প্রসেনজিৎ এর ভগ্নি শোকে প্রাণত্যাগ করেন। ইতিপূর্বে কোশল দেবীকে বিবাহ করে বিম্বিসার কোশলের অংশবিশেষ কাশীগ্রীম যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেন। কোশল দেবীর মৃত্যুর পর কোশলরাজ প্রসেনজিৎ কাশিগ্রাম তার পিতার দেওয়া যৌতুক প্রত্যাহার করে নেন। এর ফলে যে যুদ্ধ শুরু হয় তার ফলাফল প্রথমদিকে অনিশ্চিত হলেও শেষ পর্যন্ত অজাতশত্রুর অনুকূলে যায়। প্রসেনজিৎ অজাতশত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। প্রসেনজিৎ নিজেও কন্যা বজিরার সঙ্গে অজাতশত্রুর বিবাহ দেন। তাছাড়া যৌতুক রুপে অজাত শত্রু কে কাশী ফিরিয়ে দেন।

অজাতশত্রু রাজত্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো লিচ্ছবী গণরাজ্য অধিকার। জৈন গ্রন্থ ভগবতী সূত্র ও নিয়মাবলী সূত্র থেকে জানা যায় যে মোট 36 টি গণরাজ্য লিচ্ছবি রাজ চেতকের নেতৃত্বে অজাতশত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। বস্তুতপক্ষে অজাত শত্রুর বিরুদ্ধে চেতক এর নেতৃত্বে এই সংগ্রাম ছিল মগধের সাম্রাজ্যবাদের তথা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রজাতন্ত্রের সংঘাত। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল 15 বছর বা তারও বেশি। মিত্র সংঘের সঙ্গে মগধের এই বিরোধের কারণ সম্পর্কে জৈন এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে ভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায়। জৈন সাহিত্য অনুসারে বিম্বিসার বৈশালীর রাজা চেতকের দুই পুত্রকে যে মনিমুক্তা ও হস্তী দান করেছিলেন, সিংহাসন আরোহণের পর অজাত শত্রু সেই দান প্রত্যাহার করতে চাইলে এই বিরোধের শুরু হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মগধের সঙ্গে লিচ্ছবি দের এই সংগ্রামে গৌতম বুদ্ধের সহানুভূতিশীল লিচ্ছবীদের পক্ষে। এই যুদ্ধে সামরিক শক্তির যে ভূমিকা ছিল, যুদ্ধের কূটনীতির ভূমিকা তার চেয়ে কম ছিল না। এই কূটনীতির কেন্দ্রে ছিলেন অজাতশত্রুর মন্ত্রী বসসাকর। তিনি এই যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে আরও একটি ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। লিচ্ছবী গণ রাজ্যটি ছিল গঙ্গা নদীর অপর তীরে। মগধের রাজধানী রাজগৃহ গঙ্গা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় সেখানথেকে যুদ্ধ পরিচালনা করা সুবিধাজনক ছিল না। এই অসুবিধা দূর করার জন্য অজাত শত্রু গঙ্গা তীরে পাটলি গ্রামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। এইভাবে ভবিষ্যৎ পাটলিপুত্র নগরীর ভিত্তি স্থাপিত হয়।

অজাতশত্রুর সাফল্যে অপর এক শক্তিশালী রাজ্য অবন্তী পারেন, এই সম্ভাবনায় অজাতশত্রু রাজগৃহের প্রতিরক্ষার ঈর্ষান্বিত হয়। অবন্তীরাজ প্রদ্যোৎ রাজগৃহ আক্রমণ করতে সুকঠিন ব্যবস্থা করেন বলে জানা যায়। অবন্তীর সঙ্গে মগধের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কোন মীমাংসার কথা জানা যায় না। অজাত শত্রু তার রাজত্বকালের বাকি সময় প্রজাদের পক্ষে সুশাসক হয়ে ওঠেন বলেই বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ গুলির অভিমত। কি বৌদ্ধ, কি জৈন গ্রন্থ গুলি অজাতশত্রু কে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক বলে দাবি করেন। এ ব্যাপারে যা জানা যায় তা হল, অজাত শত্রু প্রথম জীবনে তীব্র বৌদ্ধ বিদ্বেষী হলেও পরবর্তী জীবনে বৌদ্ধ অনুরাগীতে পরিণত হন। ভারহুতের ভাস্কর্য থেকে জানা যায় যে- রাজধানী রাজগৃহের বহু জায়গায় তিনি ধাতুনির্মিত চৈত স্থাপন করেন। তিনি বৌদ্ধ তীর্থ দর্শন গিয়েছিলেন। নিজ এখানকার বহু বিহার কে সংস্কার করেন। সবচেয়ে বড় কথা তার উদ্যোগেই রাজগৃহে প্রথম বৌদ্ধ সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। আনুমানিক 462 খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাঁর জীবনাবসান হয়।

পরবর্তী শাসকগণ:- বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ অনুসারে, অজাতশত্রুর পর উদয়ী বা উদয় ভদ্র, অনুরুদ্ধ, মুণ্ড, নাগদশক প্রমূখ চারজন রাজা পরপর 430 খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। অজাত শত্রু পর তার পুত্র উদয়ী বা উদয় ভদ্র মগধের সিংহাসনে বসেন। তিনি পাটলিপুত্র নগরী প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে মগধের রাজধানী স্থানান্তর করেন। তিনি অবন্তীর রাজা প্রদ্যোৎ কে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পরাজিত করেন। উদয়ীর পর অনুরুদ্ধ, মুন্ড, নাগদশক পর পর রাজত্ব করেন। এরা ছিলেন অযোগ্য শাসক। এদের আমলে মগধের রাজ্য বিস্তার বা অভ্যন্তরীণ অগ্রগতি কিছুই হয়নি। নাগ দশককে হত্যা করে 430 খ্রিস্টপূর্বাব্দে শিশুনাগ মগধের সিংহাসনে বসলে হর্যঙ্ক বংশের পতন হয়।

en_USEnglish
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading