বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হুসেন শাহী বংশের শাসনকাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই বংশের প্রধান দুই সুলতান হুসেন শাহ ও নসরত শাহের কৃতিত্বে বাংলা ও বাঙালি রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল। রাজনৈতিক সংহতি, শাসনতান্ত্রিক স্থিতাবস্থা, সামাজিক সান্য, ধর্মীয় সহিষ্কৃতা ও সংস্কৃতিক বিকাশ যদি আধুনিক যুগের মানদণ্ড হয়, তাহলে হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালে বাংলা সেই আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছিল এ কথা নিঃসন্দেহ বলা চলে।
হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ ছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। ইলিয়াস শাহী বংশের অবসানে দীর্ঘ ছ-বছর বাংলায় হাবসি শাসন প্রচলিত ছিল। বাংলার ইতিহাসে হাবসি শাসনকে ‘অন্ধকার যুগ’ (Dark age) বলে অভিহিত করা হয়। সেই অত্যাচারী ও গৌরবহীন হাবসি শাসনের অবসান ঘটিয়ে হুসেন শাহ াংলাদেশে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। বক্সী নিজামুদ্দিনের মতে, হুসেন শাহ হাবসি সুলতান মুজফ্ফর শাহকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছিলেন। অপরদিকে গোলাম হুসেন ও ফিরিস্তার মতে, হাবসির কুশাসনে অতিষ্ট হয়ে বাংলার সামন্তরা হুসেন শাহকে বাংলার সিংহাসনে বসিয়েছিলেন।
হুসেন শাহ-র সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বছরের রাজত্বকাল (1493-1519 খ্রিস্টাব্দ) বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দমনে উদ্যোগী হন। এজন্য তিনি বহু হাবসি আমীর ও কর্মচারীকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। তাঁর শাসনের সূচনায় জৌনপুরের শাসকর দিল্লির সুলতান সিকন্দার লোদীর বিরুদ্ধে হুসেন শাহ-র সাহায্য চাইলে, দিল্লির সম্পোেবাংলার সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। অবশ্য হুসেন শাহের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ফলে শেষ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে শাস্তি স্থাপিত হয়। এর ফলে বাংলার পশ্চিম সীমান্ত নিরাপদ হয়।
অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সমস্যার সমাধান করে হুসেন শাহ রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। 1498 খ্রিস্টাব্দ তিনি কামতাপুর (কোচবিহার) রাজ্য আক্রমণ করে হাজো পর্যন্ত সমগ্র ভূভাগ দখল করেন। এরপর তিনি কামরূপ জয় করেন। হুসেন শাহ ওড়িশা, ত্রিপুরা ও আকারান রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। তবে এই অভিযানের ফলাফল সম্বন্ধে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। তবে বিহারের মুঙ্গোর, পাটনা প্রভৃতি জেলায় প্রাপ্ত হুসেন শাহ-র বিভিন্ন শিলালিপি থেকে অনুমিত হয়, ওই সব স্থানে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রজাহিতৈষণা ও উদারতার জন্যও হুসেন শাহ-র নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে ‘History of Bengal’-এ বলা হয়েছে: “The name of Hussain Shah, the good is still remembered from the frontiers of Orissa to the Brahmaputra.” তিনি ছিলেন উদারতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর শাসনাধীন বাংলায় হিন্দুদের জীবন ও ধর্ম ছিল সচ্ছল ও নিরাপদ। বলা হয়ে থাকে আকবরের পূর্বে মধ্যযুগের কোনো সুলতান হুসেন শাহ-র মতো উদারতা ও বদান্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। ‘History of Bengal’-এর ভাষায়: “…but for his (Hussain Shah) liberalism and catholicity of mind of which it is hard to find a parallel in Muslim India until the age of the great Akbar.”
কর্মচারী নিয়োগে হুসেন শাহ যোগ্যতাকে মূল্য দিতেন, ধর্মকে নয়। রূপ ও সনাতন নামক দুই ভাই যথাক্রমে হুসেন শাহের রাজস্ব সচিব (সাকর মল্লিক) ও ব্যক্তিগত সচিব (দবীর খাস) পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এ ছাড়া তার উজীর ছিলেন গোপীনাথ বসু, সেনাপতি ছিলেন গৌরব মল্লিক প্রমুখ। এইভাবে হিন্দুগণকে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করে তিনি হিন্দু প্রজাবর্গের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
হুসেন শাহর পর বাংলার সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র নসরত শাহ (1519-1532 খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর রাজত্বকালের প্রথমার্ধ মোটামুটি শান্তিতে কেটেছিল। ওই সময়ে তিনি শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রত্যক্ষ উৎসাহে ও সাহায্যে বাংলায় বিশেষত পান্ডুয়া ও গৌড়ে একাধিক সুন্দর স্থাপত্য কর্ম নির্মিত হয়েছিল। তাঁর রাজত্বের দ্বিতীয়ার্ধে বারবার সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সমস্যা তাকে বিব্রত করে তোলে। মুঘলবীর বাবর ইতিমধ্যে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করলে বাংলার বিপদ উপস্থিত হয়। নসরত শাহ বাবরের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে নিজ অধিকার অব্যাহত রাখতে সক্ষম হন। এরপর তিনি অহোম রাজ্যের বিরুদ্ধে হাটি অভিযান পাঠান, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। এক আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন।