অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধস্বর কখনো একমাত্রা এবং কখনো দুই মাত্রা বহন করে। অর্থাৎ পর্বে মাত্রা গণনা রীতি কোথাও স্বরবৃত্তের আবার কোথাও মাত্রাবৃত্তের মতন। বদ্ধস্বর যদি শব্দের প্রথম বা মাঝে থাকে তবে তা এক মাত্রা কিন্তু শব্দের শেষে অবস্থান করলে দুই মাত্রা বহন করে। উদাহরণ স্বরূপ “সূর্যশোক” শব্দটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
স্বর বিন্যাসে শব্দটি নতুন করে লিখে আমরা পাই:
সূর + য + শোক
প্রথম এবং শেষেরটি বদ্ধস্বর, কিন্তু মাঝেরটি মুক্তস্বর। “সূর” বদ্ধস্বরটি শব্দের প্রথমে থাকায় এর মাত্রা সংখ্যা এক। অন্যদিকে “শোক” বদ্ধস্বরটি শব্দের শেষে থাকায় এর মাত্রা সংখ্যা দুই। আর মুক্ত স্বর “য”-এর মাত্রা সংখ্যা সর্বদাই এক। অতএব অক্ষরবৃত্তের এই নিয়মে “সূর্যশোক” এর মাত্রা সংখ্যা চার।
মাত্রা বিন্যাস:
সূর্যশোক
সূর + য + শোক
= ১ + ১ + ২
= ৪
মাত্রা বিন্যাস সহ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত কয়েকটি কবিতা।
পর্বে আট মাত্রা এবং অতিপর্বে ছয়মাত্রা আছে এমন একটি কবিতা:
১. হাজার বছর ধরে/ আমি পথ হাঁটিতেছি/ পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে/ নিশীথের অন্ধকারে/ মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ;/ বিম্বিসার অশোকের/ ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি;/ আরো দূর অন্ধকারে/ বিদর্ভ নগরে;
(বনলতা সেন/ জীবনানন্দ দাশ)
কাঠামো:
৮ + ৮ + ৬
এখানে “সংহল” “সমুদ্র” “অন্ধকার” এবং “বিম্বিসার” শব্দ চারটি লক্ষ্য করা যায়। প্রথম শব্দ দু’টি তিনটি করে এবং শেষের শব্দ দু’টি চারটি করে মাত্রা বহন করছে।
এদের স্বর ও মাত্রা বিন্যাস নিম্নরূপ:
সিংহল
সিং + হল
= ১ + ২
= ৩
সমুদ্র
স + মুদ + রো
= ১ + ১ + ২
= ৩
অন্ধকার
অন্ + ধো + কার
= ১ + ১ + ২
= ৪
বিম্বিসার
বিম + বি + সার
= ১ + ১ + ২
= ৪
দেখা যাচ্ছে, শব্দের প্রথমে এবং মাঝে অবস্থিত বদ্ধস্বরগুলি এক মাত্রা কিন্তু শেষে অবস্থিত বদ্ধস্বরগুলি দু’মাত্রা বহন করছে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গণনার এই রীতি কবি ইচ্ছা করলে বদলে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে সব বদ্ধস্বরকে দিতে হবে দু’মাত্রা বহন করার ক্ষমতা। তবে, সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যাতে পুরো কবিতায় একই নিয়ম প্রতিফলিত হয়। এক কবিতায় দু’রকম নিয়ম অনুসরণ করলে একদিকে পাঠক যেমন বিভ্রান্ত হবেন, অন্যদিকে কবিরও ছন্দে অদক্ষ হাতের প্রমাণ থেকে যাবে।
সকল বদ্ধস্বরকে দু’মাত্রা বহন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এমন একটি কবিতা:
২. বহুদিন থেকে আমি/ লিখছি কবিতা
বহুদিন থেকে আমি/ লিখিনা কবিতা
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা/ সৈয়দ শামসুল হক)
কাঠামো:
৮ + ৬
এখানে “লিখছি” শব্দটির “লিখ” বদ্ধস্বরটি শব্দের প্রথমে বসেও দুই মাত্রা বহন করছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রম। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, এটা কবির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
শব্দের প্রথম ও মাঝের বদ্ধস্বরকে একমাত্রা দেয়া হয়েছে এমন আরো দু’টি কবিতা:
৩. …রহে বলী; রাজদণ্ড/ যত খণ্ড হয়
তত তার দুর্বলতা,/ তত তার ক্ষয়।
একা সকলের উর্ধ্বে/ মস্তক আপন
যদি না রাখিতে রাজা,/ যদি বহুজন…
(গন্ধারীর আবেদন/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাঠামো:
৮+৬
৪. হে দারিদ্র্য তুমি মোরে/ করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়েছ/ খ্রীস্টের সম্মান।
কণ্টক-মুকুট শোভ!/ ─দিয়াছ, তাপস
অসঙ্কোচ প্রকাশের/ দুরন্ত সাহস:
(দারিদ্র / কাজী নজরুল ইসলাম)
কাঠামো:
৮ + ৬
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ দু’টি কবিতাই চোদ্দ মাত্রার সনেট নির্মাণের কাজে অবদান রাখতে পারে। সনেট অধ্যায়ে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
এবার অন্য একটি কবিতা:
৫. ক্রূর ঝড় থেমে গেছে,/ এখন আকাশ বড়ো নীল/
গাছের সবুজ পাতা/ কেঁপে কেঁপে অত্যন্ত সুষম/
বিন্যাসে আবার স্থির/
(বাজপাখি / শামসুর রাহমান)
এই কবিতাটির প্রতিটি লাইনের প্রথম পর্ব আট মাত্রা এবং দ্বিতীয় পর্ব দশ মাত্রা বহন করছে। যদি পর্বের আলোচনার আলোকে এটা বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বলা যায় শেষের দশ মাত্রার পর্বটি অতিপর্ব। কিন্তু তা কি করে হয়? অতিপর্বের মাত্রা তো পর্বের মাত্রা সংখ্যা থেকে কম হওয়ার কথা। তবে কি এক্ষেত্রে মন্তব্য করা যাবে যে কবিতাটি লেখা হয়েছে ৮+৮+২ কাঠামোতে অর্থাৎ আট মাত্রার দু’টি পর্ব এবং দুই মাত্রার অতিপর্ব রেখে। কিন্তু তাও ঠিক নয়। কারণ, প্রথম লাইনের “নীল” শব্দটি দুইমাত্রা বহন করায় এটাকে দুই মাত্রার অতিপর্ব ধরলেও ধরা যায়। কিন্তু সমস্যা হয় দ্বিতীয় লাইনের “সুষম” শব্দটিকে নিয়ে। দুই মাত্রার অতিপর্ব বের করতে হলে “সুষম” থেকে “সু” স্বরটিকে পূর্বের পর্বের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, এবং “ষম” কে অতিপর্ব ধরতে হয়। অর্থাৎ তিন অক্ষরের এই শব্দটিকে ভেঙে দিয়ে কবিতার পর্ব বিন্যাস করতে হয়। এক্ষেত্রে যা যুক্তিপূর্ণ নয়। তাই এই কবিতাটিকে “আট-দশ” মাত্রার বা “আট-দশ” চালের কবিতা বলা প্রয়োজন, যা অক্ষরবৃত্তে কবিতা লেখার অন্য একটি নিয়ম হিসেবে বেশ কয়েক যুগ ধরে বাংলা কবিতায় প্রচলিত এবং এটাই হচ্ছে আঠারো মাত্রার সনেট গঠনের নির্ভরযোগ্য কাঠামো।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আলোচনায় অগ্রসর হলে মনে হতে পারে যে এর অঙ্গন অনেক প্রশস্ত এবং কিছুটা খোলামেলা।
আসলেই তাই। বাংলা কবিতার ত্রিশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিরা অক্ষরবৃত্তের উপর প্রচুর কাজ করেছেন এবং একে একটা মুক্ত রূপ দিয়েছেন; যা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়মকে ঠিক রেখে পর্বে মাত্রা বাড়িয়ে কমিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্ব ভেঙেচুরে ছন্দকে শাসন করে সজোরে আছাড় মেরে কবিতাকে সোজা করে দাঁড় করা হয়েছে। উঁকি দিয়েছে অক্ষরবৃত্তের নতুন ধারা। অক্ষরবৃত্তের এই নতুন রূপকে অনেকে “মুক্ত ছন্দ” বলেন। কিন্তু আমরা একে “নঞ ছন্দ” বলবো। নাই অর্থে নঞ। অর্থাৎ সাধারণ ভাবে দেখলে কবিতায় ছন্দ নেই, কিন্তু বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করলে ছন্দের দৃঢ় বন্ধন দৃষ্টিগোচর হয়। নঞ ছন্দের উদাহরণ লক্ষ্য করা যাক:
১. আকাশ জানে না,/
প্রকাশ রাস্তায় একী/ কুড়ানো স্বাক্ষর,/
নক্ষত্র সমাজ খোঁজে/ শেষ পরিচয়/
ওরা পরস্পর/
নূতন বিরহে পায়/ অভিন্ন বিচ্ছেদে দীপ্তিময়/
উদ্ভাসিত দূরে দূরে/ অনন্ত বাসর।/
(যুগ্মদূর/ অমিয় চক্রবর্তী)
কাঠামো:
৬
৮ + ৬
৮ + ৬
৬
৮ + ১০
৮ + ৬
২. সজীব সকালে চোখ মেলি,/ প্রতিদিনের পৃথিবী/
আমাকে জানায় অভি/ বাদন। টাটকা রোদ
পাখিদের উড়াউড়ি,/ গাছের পাতার দুলুনি,/ বেলফুলের গন্ধ/
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে/
(একটি দুপুরের উপকথা / শামসুর রাহমান)
কাঠামো:
১০ + ৮
৮ + ৮
৮ + ৮ + ৮
১৪
৩. যখন তাদের দেখি/ হঠাৎ আগুন লাগে/ চাষীদের মেয়েদের/
বিব্রত আঁচলে;/ সমস্ত শহর জুড়ে/ শুরু হয় খুন, লুঠ,/ সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,
ভেঙে পড়ে শিল্পকলা,/ গদ্যপদ্য;/ দাউদাউ পোড়ে/ পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের;
ডাল থেকে/ গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে/ ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল
আর্তনাদ করে বাঁশি/ যখন ওঠেন মঞ্চে/ রাজনীতিবিদগণ।
(রাজনীতিবিদগণ/ হুমায়ুন আজাদ)
কাঠামো:
৮ + ৮ + ৮
৬ + ৮ + ৮ + ১০
১০ + ৪ + ৬ + ৮
৪ + ৮ + ১০
৮ + ৮ + ৮
এইসব উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে পর্বে মাত্রা সংখ্যা অসমান; কিন্তু জোড় মাত্রার পর্ব গঠিত হয়েছে।
মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার সহজ উপায়
এখন প্রশ্ন হলো মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার নিয়ম কি? এ ছন্দে লেখা কবিতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে যা ধরা পড়বে তা হলো:
১. অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়ম ঠিক থাকবে।
২. প্রতিটি পর্বে জোড়সংখ্যক মাত্রা থাকতে হবে।
৩. পর্বে মাত্রা সংখ্যা দুই থেকে শুরু করে চার, ছয়, আট, দশ যে কোনো সংখ্যক রাখা যেতে পারে।
মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার সময় যদি একটা বিশেষ নীতি মেনে চলা হয় তবে উপরের তিনটি শর্তই একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব। নীতিটি হলো:
জোড়ে জোড়, বিজোড়ে বিজোড়।
তার মানে জোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি জোড় মাত্রার শব্দ এবং বিজোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি বিজোড় মাত্রার শব্দ বসানো। এরপর ইচ্ছা মতো লাইন তৈরি করা হলেও ছন্দের কোনো বিচ্চুতি ঘটে না।