আত্ম-শক্তিশালী আন্দোলনের তাৎপর্য সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত নোট লেখ।

আত্ম-শক্তিশালী আন্দোলন (Self-Strengthening Movement) – তাৎপর্য:

আত্ম-শক্তিশালী আন্দোলন ছিল চীনের ১৯শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক প্রচেষ্টা, যা চীনের চিং সাম্রাজ্য (1644-1912) কর্তৃক পশ্চিমী শক্তির আগ্রাসন এবং আধুনিকীকরণের চাপের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই আন্দোলন, যা ১৮৬১ থেকে ১৮৯৫ সালের মধ্যে চলেছিল, চীনের প্রশাসনিক, সামরিক, এবং শিল্পের ক্ষেত্রে পশ্চিমী প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান গ্রহণের মাধ্যমে চীনা সমাজ ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠনকে লক্ষ্য করেছিল। এর মাধ্যমে চীন পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিল, কিন্তু এটি তার পূর্ণ সম্ভাবনাকে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, কারণ সংস্কারগুলো ছিল আধিক্যহীন এবং তা মূলত সামরিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল।

প্রেক্ষাপট:

চীনের চিং সাম্রাজ্য ১৮শ শতকের শেষ ও ১৯শ শতকের প্রথম ভাগে বিদেশি শক্তির আগ্রাসন এবং রাজনৈতিক দুর্বলতার সম্মুখীন হয়। প্রথম আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-১৮৪২) এবং দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ (১৮৫৬-১৮৬০) চীনের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে পরাজয়ের ফলস্বরূপ, চীনের অর্থনৈতিক, সামরিক, এবং রাজনৈতিক কাঠামোতে একটি বিপর্যয় ঘটেছিল। চীনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এক ধরনের স্থবিরতায় আটকে পড়ে, যখন পশ্চিমী দেশগুলো তাদের আধুনিক সামরিক শক্তি এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে চীনে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। আফিম যুদ্ধের পর, চীন বিদেশি শক্তির কাছে অতিরিক্ত এক ধরনের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়, যা তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে।

এই পরিস্থিতিতে, চীনা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, বিশেষ করে কুয়াংজি (Kuangxi) সম্রাটের শাসনামলে, চীনের আধুনিকীকরণ এবং বিদেশি আগ্রাসনের প্রতিরোধের জন্য কিছু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই সংস্কারের প্রচেষ্টারই নাম ছিল “আত্ম-শক্তিশালী আন্দোলন”।

আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য:

আত্ম-শক্তিশালী আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল পশ্চিমী প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, এবং সামরিক কৌশল গ্রহণ করে চীনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং সামরিক ক্ষমতা পুনর্গঠন করা। এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চীনের দারিদ্র্য ও অবক্ষয় থেকে উত্তরণ এবং দেশকে পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে তোলা।

১. সামরিক সংস্কার: এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল চীনের সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণ করা। সামরিক ক্ষেত্রে পশ্চিমী প্রযুক্তি, বিশেষ করে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল। চীনের সাবেক সামরিক কাঠামো ছিল প্রাচীন এবং এটি পশ্চিমী শক্তির কাছে দুর্বল ছিল। তাই, আধুনিক প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

২. শিল্প প্রযুক্তির উন্নয়ন: অপরদিকে, শিল্পক্ষেত্রে চীনের অগ্রগতি খুবই ধীর ছিল। চীন একদিকে প্রাচীন কৃষিপদ্ধতিতে আবদ্ধ ছিল, অন্যদিকে পশ্চিমী শক্তি তাদের শিল্প সংস্কৃতির মাধ্যমে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। চীনের সরকারের দৃষ্টি ছিল আধুনিক শিল্প প্রযুক্তি গ্রহণ করে দেশীয় শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা। এ জন্য পশ্চিমী মডেল অনুসরণ করে বিভিন্ন মেশিন এবং যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়।

৩. শিক্ষা সংস্কার: পশ্চিমী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, এবং বিশেষ করে প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। চীনে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে পশ্চিমী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর শিক্ষা প্রদান করা হত।

আন্দোলনের কার্যক্রম:

আত্ম-শক্তিশালী আন্দোলনের সময় বেশ কিছু সংস্কারমূলক কাজ শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:

১. শিল্প স্থাপন: চীন শিল্প উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন কারখানা স্থাপন করে, বিশেষ করে শস্য-প্রস্তুতকারী কারখানা, অস্ত্র তৈরির কারখানা এবং তামা ও লোহার কারখানা।
২. নৌবহরের আধুনিকীকরণ: চীন সমুদ্র বাণিজ্যে সমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের নৌবহর ছিল অত্যন্ত পুরনো। তাই, নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজ আমদানি করা হয় এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
৩. বিজ্ঞান প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ: চীনে পশ্চিমী বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়, যেমন বিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, এবং কৃষি প্রযুক্তি।

সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা:

যদিও আত্ম-শক্তিশালী আন্দোলনের কিছু সফলতা ছিল, তবুও এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার আন্দোলন হতে পারেনি। এর কয়েকটি প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল:

১. সংস্কারের অপ্রতুলতা: আন্দোলনটি মূলত সেনাবাহিনী এবং শিল্প সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিশেষ সংস্কার গ্রহণ করা হয়নি।
২. রাজনৈতিক অস্থিরতা: আন্দোলনটি চীনের কেন্দ্রীয় সরকার এবং ক্ষমতাশালী বুরোক্র্যাটদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
৩. বিদেশি চাপ: চীন সেই সময়ে পশ্চিমী শক্তির আক্রমণ এবং বিদেশি চাপের মুখে ছিল। এর ফলে, চীনের প্রচেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সীমিত হয়ে পড়েছিল এবং বিদেশি শক্তির প্রতি আত্মসমর্পণ করা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে।

পরিণতি ও তাৎপর্য:

আত্ম-শক্তিশালী আন্দোলন চীনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হলেও, এটি সঠিকভাবে সফল হয়নি। পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে চীনকে শক্তিশালী করার যে উদ্দেশ্য ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। তবে, আন্দোলনটি চীনে আধুনিকীকরণের ধারণাকে প্রবর্তন করেছিল, যা পরবর্তীতে ২০শ শতকের শুরুতে চীনে বৃহত্তর সংস্কারের দিকে পরিচালিত করেছিল।

এটি চীনের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং চীনা সমাজে আধুনিকতার দিকে এক ধরনের সজ্ঞানে প্রবাহ তৈরি করেছিল। আন্দোলনের মাধ্যমে চীনে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ভাবনা ও আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশ ঘটেছিল, যা পরবর্তীতে চীনা বিপ্লবের সূচনা ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।

অতএব, আত্ম-শক্তিশালী আন্দোলন চীনের ইতিহাসে একটি নতুন চিন্তা ও পরিবর্তনের প্রেরণা জুগিয়েছিল, যদিও এটি তার পূর্ণতা পায়নি।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading