আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনের ইতিহাস বর্ণনা করো

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তন –

 আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল জ্ঞানের একটি পূর্ণবিকশিত স্বতন্ত্র শাখা। এটি বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পারিক সম্বন্ধ, অরাষ্ট্রীয় সংস্থা, বহুজাতিক কর্পোরেশনসমূহ, আন্তর্জাতিক সংগঠন, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরাপত্তা, নিরস্ত্রীকরণ ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

 জ্ঞানচর্চার পটভূমিতে স্বতন্ত্র পাঠ্য বিষয় হিসাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আবির্ভাব একটি সাম্প্রতিক ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরে University College of Wales -এ মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের নামাঙ্কিত একটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশদ চর্চা শুরু হলেও এর অনেক আগে চীনের দার্শনিক মেনসিয়াস, ভারতের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ কৌটিল্য, ইতালির চিন্তাবিদ মেকিয়াভেলির রচনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কিছু মৌলিক চিন্তাভাবনার কথা লক্ষ্য করা যায়।


 সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পণ্ডিতরা মনে করেন আধুনিক ভূখণ্ডকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। তিরিশ বছর ধরে রক্তক্ষয়ী ধর্মযুদ্ধের পর ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির ফলে গড়ে ওঠা আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভবকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা বলে অভিহিত করা হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে পারস্পারিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য সম্পর্ক প্রস্তুত করতে পারবে।

 শিল্প বিপ্লব এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: 
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনের ধারাকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই পর্যায়ে জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতি ধারণাগুলির উপর আলোকপাত ঘটেছিল।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনে সুনির্দিষ্ট এবং বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা দেখা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইউরোপের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা বিস্তারের লড়াই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের চোদ্দ দফা প্রস্তাব আন্তর্জাতিক দরবারে উপস্থিত হলে উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা, গোপন কূটনীতির অবসানসহ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংকল্পের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি নতুন পর্যায়ে বিকাশ লাভ করে।

      প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর জাতি সংঘের (League of Nations) প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। এই সময় থেকেই শুরু হয় প্রকাশ্য কূটনীতিক যুগ। এই ভাবেই ভবিষ্যতে যুদ্ধের সম্ভাবনা রোধের জন্য বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের উপায়ের অনুসন্ধান আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে শেষ পর্যন্ত জ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে আবির্ভূত হয়ে সাহায্য করে।


 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিন্যাস:  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা মানুষকে পরিপূর্ণ শান্তিকামী করে তোলে। আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্বের শান্তিকামী রাষ্ট্রনেতৃবৃন্দ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations organization) গড়ে তোলেন। এই সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতি দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী জোট এবং অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক জোটের মধ্যে শুরু হয় ঠাণ্ডা যুদ্ধ (Cold war)। পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি নিয়ে গড়ে ওঠে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন। এই সময়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে আনবিক অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলা, সামরিক ঘাটি নির্মাণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বাজার প্রতিষ্ঠা, আদর্শবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বাস্তববাদীর তাত্ত্বিক চিন্তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশধারাকে বিবর্তিত করেছে।

একমেরু বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিন্যাস: ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে শক্তি তারতম্যের পরিবর্তন ঘটে। এই সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একমেরুবিশ্বের আবির্ভাব ঘটে। এই সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা। যার পর্যালোচনা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বিকশিত করেছে।

একুশ শতক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিন্যাস: একুশ শতকের তথ্য প্রযুক্তিগত বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিকের সুত্রপাত করে। এর পাশাপাশি নারীবাদীতত্ত্ব, উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ, উত্তর আধুনিকতাবাদ চিন্তা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক : বিশ্বায়ন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বিশ্বায়নের ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বহুজাতিক কোম্পানি এবম্নগ ভোগ্যপণ্যের বিশ্ববাজারের বিস্তৃতি ঘটেছে।

মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের প্রক্রিয়া আজও চলমান।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading