1942 সালে জাতীয় কংগ্রেসের দেওয়া ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক উত্তরবঙ্গোর রাজনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলনকে এক চূড়ান্ত বিকাশের স্তরে নিয়ে যায়। সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে প্রচণ্ড গণ-উম্মাদনা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আন্দোলনের স্থানীয় শত শত নেতাদের জেলে পুরেও আন্দোলনের কোনো ঘাটতি ঘটাতে পারা যায়নি। তখন পুলিশের সাহায্যের জন্য সৈন্য নামিয়ে দেওয়া হয়। তারই মধ্যে চলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসকার্য। থানা জ্বলল, কোর্ট পুড়ল, রেললাইন উপড়ে ফেলা হল। সারা ভারতের মতো উত্তরবঙ্গোও তখন একটিই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল-“করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।”
জলপাইগুড়িতে এই আন্দোলনের সমর্থনে পৌর কমিশনারগণ পদত্যাগ করেন। ছাত্ররা স্কুলকলেজ ছেড়ে মিছিলে অংশ নেয়। 4 আগস্ট জলপাইগুড়ির ইতিহাসের বোধহয় সর্ববৃহৎ মিছিল তারাপদ ব্যানার্জি ও উমা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে শহরময় ঘুরে বেড়ায় এবং সরকারি কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে যায়। মালদা জেলায় এই আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন পিল্লা নিবাসী সুবোধকুমার মিশ্র। তাঁর নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে জনতা রেললাইন তুলে ফেলে, টেলিগ্রামের তার ও খুঁটি উপড়ে ফেলে, পোস্ট অফিস ও রেলস্টেশনে আগুন সংযোগ করে। 1942 সালের 4 আগস্ট সরকার সুবোধকুমার মিশ্রকে বন্দি করে হাজতে নিয়ে আসে; কিন্তু এক বিপুল জনতার বিক্ষুদ্ধ জোয়ার তাঁকে ব্রিটিশের হাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়।
দিনাজপুরে এই আন্দোলন সম্পূর্ণ গণ-বিদ্রোহের রূপ নেয়। 13 সেপ্টেম্বর রাতে কমপক্ষে 8000 লোকের এক বিরাট বাহিনী গোপনে ডাঙ্গিঘাটে সমবেত হয় এবং সরোজ চ্যাটার্জির নেতৃত্বে পরদিন সকালে বালুরঘাট শহরকে ঘিরে ফেলে। অবরুদ্ধ শহরের মধ্যে তখন শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। সাব-রেজিস্ট্রি অফিস অগ্নি সংযোগে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। দেওয়ানি আদালত ও সমবায় ব্যাংক-ভবন ভস্মীভূত হয়। টেলিগ্রাফের তার ও যন্ত্রপাতি ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। সারাদিন ধরে জনতা সম্পূর্ণ শহরটিকে তছনছ করে ফেলে। পোস্ট অফিস, রেলস্টেশন, কৃষি অফিস, গোডাউন এমনকি ইউনিয়ন বোর্ডের অফিস পর্যন্ত আক্রান্ত ও বিধ্বস্ত হয়। গাঁজা ও মদের দোকান চুরমার করা হয়। শহর সারাদিন আন্দোলনকারীদের দখলে থাকে। পরদিন সকালে বিরাট পুলিশবাহিনী শহরে প্রবেশ করে এবং বিক্ষোভকারীদের কবল থেকে শহরকে উদ্ধার করে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তখন থানাতে বিক্ষুদ্ধ জনতার ওপর গুলি চালিয়েছিলেন। এই সব জনতা তেলিঘাটা থেকে চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। সারা মহকুমায় হাজার হাজার লোককে কয়েদ করা হয়। সর্বত্র সভা ও মিছিল বের করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সরোজবাবুর মাথার দাম এক হাজার টাকা ঘোষণা করা হয়। তা ছাড়া বালুরঘাট শহরেই শুধু 75000 টাকা পিটুনি কর ধার্য করা হয়। সারা ভারত জুড়ে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিপুল উচ্ছ্বাস ব্রিটিশকে তার ভারতীয় সাম্রাজ্য-শাসনের শেষ প্রহরের ঘণ্টা শুনিয়ে দেয় এবং ভারতবর্ষে আর থাকা যাবে না-এই বিষয়ে ব্রিটিশরা নিশ্চিত হতে পেরেছিল। তবুও বেশ কিছু টালবাহানার পরে ইংরেজরা 1947 সালের 15 আগস্ট ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিল।