:
উত্তরবঙ্গের চা-বাগিচার উৎপত্তি :
ভারতে চা উৎপাদন ও তা ব্যবহারের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। ইংরেজদের ভারত শাসন পর্বের আগে ভারতে চা উৎপাদিত হত ও তা ব্যবহৃত হত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার উপকরণ হিসেবে। কিন্তু ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের পর থেকে চা-এর উৎপাদন পদ্ধতি ও ব্যবহারে এক ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ব্রিটিশ ভারতে চায়ের প্রথম রেকর্ডটি 1780 সালের, যখন ক্যান্টন থেকে আনা কয়েকটি চায়ের ঝোপ কলকাতায় রোপণ করা হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ, অনুকূল আবহাওয়া বা মাটির অবস্থার কারণে সেই গাছগুলি বেশিদিন বাঁচেনি। পরবর্তীকালে বিহার ও কোচবিহার অঞ্চলকে চা চাষের উপযোগী বলে বিবেচনা করে ব্রিটিশ চা উৎপাদক গোষ্ঠী। তখনও পর্যন্ত অসম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে আসেনি। 1819 সালে অসমের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মি. স্কট অসমে চা চাষ করার উদ্যোগ নিলেও সফল হননি। কয়েক বছর পর, অসমের একজন সিংপো প্রধান মেজর ব্রুসকে অসমের শিবসাগর অঞ্চলে দেশীয় চা গাছের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত করেন। অবশেষে এই চা গাছের নমুনাগুলি পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য ড. ওয়ালিচের কাছে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে চিনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবলুপ্তি ঘটে এবং তখন থেকেই ইংরেজরা ভারতে চা চাষের জরুরি প্রয়োজন বুঝতে পারে।
ভারতীয় চা শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। পশ্চিমবঙ্গোর চা শিল্পে সামগ্রিক অবস্থান অসমের পরেই। পশ্চিমবলো 1856 সালে পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় দাজিলিং পাহাড়ে, যখন চা বিশারদ ড. গার্ডেন চিন থেকে ভারতে ফিরে আসেন কিছু চা বীজ ও চারা নিয়ে। দার্জিলিং পাহাড়ে ড. ক্যাম্পবেলকে 1841 সালে পরীক্ষামূলক চা চাষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাম্পবেল সাহেব সেই চিনা চারাগুলিকে জলপাহাড় ও আলুবাড়ি এলাকায় রোপণ করেছিলেন যে অঞ্চলটি ছিল 9০০০ ফুট উঁচুতে। সেখানে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পরীক্ষাটি কোনো ইতিবাচক ফলাফল দেয়নি। অবশেষে মি. ক্রানেমেলিন দার্জিলিং-এ কম উচ্চতায় একটি নার্সারি স্থাপন করেন ও সফল হন। এরপর থেকে চা চাষ দার্জিলিং-এর নিম্ন উচ্চতা অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবে 1856 সালে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হলে এই বাগিচা শিল্পের উৎপাদনে ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়। উত্তরবঙ্গের প্রথম চা বাগানে স্থাপন করা হয় কার্শিয়াং ও দার্জিলিং চা কোম্পানির উদ্যোগে আলুবাড়িতে। এর প্রায় 20 বছরের মধ্যেই উত্তরবঙ্গোর তরাই অঞ্চলে 115টি চা বাগান স্থাপিত হয়, যা 18,888 একর জমি জুড়ে অবস্থান করেছিল। মি. জে হোয়াইট কর্তৃক 1862 সালে ‘চামটা চা বাগান’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তরাই অঞ্চলে চা উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তীকালে ডুয়ার্সেও চা উৎপাদন সম্প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা ডুয়ার্সের প্রথম চা বাগানটি 1876 সালে গজলডোবায় স্থাপন করেছিল এবং এর কান্ডারি ছিলেন মি. আর হটন। এইভাবে উত্তরবঙ্গ্যের চা চাষের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং যাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে বাংলার অর্থনীতি আবর্তিত হয়।
উত্তরবঙ্গের চা শিল্প হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কোচবিহার ও উত্তর দিনাজপুরের কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। প্রযুক্তিগতভাবে বাংলার সমগ্র চা উৎপাদনকারী অঞ্চলকে তিনটি বলয়ে ভাগ করা হয়েছে-তরাই, ডুয়ার্স এবং দার্জিলিং পাহাড়। তরাই দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার এলাকা ও উত্তর দিনাজপুরের একটি অংশ জুড়ে রয়েছে। দার্জিলিং পাহাড় অঞ্চল দার্জিলিং জেলার দার্জিলিং মহকুমা, কার্শিয়াং, উপ-বিভাগ ও কালিম্পং মহকুমাকে আচ্ছাদিত করে। ডুয়ার্স সম্পূর্ণভাবে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহার জেলার একটি বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে। উত্তরবঙ্গের মোট 276টি চা বাগান (পশ্চিমবঙ্গা সরকার, 2014-এর রিপোর্ট অনুযায়ী) এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
উত্তরবঙ্গের চা-বাগিচার বৃদ্ধি এবং বিকাশ :
ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে উত্তরবঙ্গোর চা শিল্পে বৃদ্ধি ও বিকাশ একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। যার সময়কাল ছিল মোটামুটিভাবে 1850 থেকে 1947 সাল পর্যন্ত।
উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের বৃদ্ধি ও বিকাশে 1850-এর পর থেকে একটি তীব্র বাঁক নেয়। এরপর থেকে প্রায় 40 বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে চা উৎপাদন ক্ষেত্র বিশেষত মোট উৎপাদন ও হেক্টর প্রতি গড় ফলন সব দিক থেকেই অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি লক্ষ করা হয়েছিল। ভারতীয় চা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী 1850 থেকে 1890 সালের মধ্যে মোট উৎপাদন ও হেক্টর প্রতি গড় ফলন হয়েছিল যথাক্রমে 0.097 থেকে 57 মিলিয়ন কিলোগ্রাম ও 130 থেকে 373 কিলোগ্রাম।
1890 থেকে 1918 সাল পর্যন্ত সময়কাল ছিল উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের সামগ্রিক বিকাশের সময়কাল। নিম্নলিখিত কারণগুলি এই শিল্প বিকাশের সহায়ক হয়েছিল- ① এই সময়কালে চা চাষের গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়।
② 1903 সালে ভারতীয় চা আইন প্রণয়ন হয়, যাতে ভারতে চা শিল্পকে সুসংহত রূপদান করা যায়।
③ তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল এই সময়কালে উত্তর ভারতে ইউনাইটেড প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ ইন্ডিয়া এবং অন্যান্য অনেক নিয়োগকর্তা সমিতি গঠিত হয়।
1918 থেকে 1939 সাল পর্যন্ত, ভারত তথা উত্তরবঙ্গের চা শিল্প এক অন্ধকারময় সময়ের মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছিল। এই সময়কালে চা উৎপাদন ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ করা যায়নি। এমনকি চা-এর দামেও ঘাটতি দেখা যায় 1919-20 সালে আর 1939 সালে, বিশ্বব্যাপী মন্দা চা শিল্পকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এই সময়কালে চা শিল্প একটি লাভজনক শিল্প বলে বিবেচিত হত। তবে 1939 থেকে 1950 সালের মধ্যে উত্তরবঙ্গের ও সেই সঙ্গে সমগ্র ভারতের চা শিল্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পৃথিবীতে ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ পায়। যুদ্ধের সময় ইন্দোনেশিয়ার মতো কিছু দেশ চা উৎপাদন বন্ধ করে দিলে ভারতীয় চা কোম্পানিগুলি এই সুযোগটি উপলব্ধি করে এবং চা উৎপাদন ও রপ্তানিতে মনোনিবেশ করে। এই সময়কাল ছিল ভারতীয় চা শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। এই সময় ইংল্যান্ডও উত্তরবঙ্গের চায়ের ক্রেতা হয়ে ওঠে। এর ফলস্বরূপ উত্তরবঙ্গ তথা ভারতের চা শিল্প বিপুল মুনাফা অর্জন ও রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ভারতীয় চা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 1939 থেকে 1950 সালের মধ্যে চায়ের মোট উৎপাদন ও হেক্টর প্রতি মোট ফলন হয়েছিল যথাক্রমে 205 থেকে 278 মিলিয়ন কিলোগ্রাম ও 610 থেকে 881 কিলোগ্রাম।
পরিশেষে বলা যায়, 1951 সালের পর থেকে স্বাধীনোত্তর ভারতে উত্তরবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতের চা শিল্প প্রতি 5 বছর অন্তর অন্তর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে