ঔপনিবেশিক পর্বে শিল্পকলার গতি-প্রকৃতি, বিশেষ করে বাংলার শিল্পকলা সম্পর্কে বর্ণনা কর

শিল্পচর্চায় বাংলার ঐতিহ্য কয়েক হাজার বছরের। হরপ্পান সভ্যতার যুগে, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকেই বাংলায় শিল্পকলা চর্চার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে পাওয়া মৃৎপাত্রের গায়ের অলঙ্করণ যাঁরা করেছেন, তাদের শিল্পবোধ ও অঙ্কন-দক্ষতা ছিল, এ কথা অনস্বীকার্য।১ সেই থেকে শুরু করে বাঙালির ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকেই দিক বদলেছে বাংলার চিত্রকলা চর্চাও। প্রাক-মুসলিম যুগে এই চিত্রকলার সবচেয়ে জোরালো মাধ্যম ছিল তালপাতার পুঁথি; মুসলিম আমলে তার জায়গাটা নিয়েছিল আরবি-ফারসি পাণ্ডুলিপি আর দরবারি শিল্পীর আঁকা মুরাক্কা বা অ্যালবাম। তবে চিত্রকলা চর্চার মূল রীতিটা ছিল অভিন্ন, রাজা-বাদশাহ কিংবা তাঁদের দরবারি অভিজাতবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে চলতো সুকুমার শিল্পের ধারা। এর বিপরীতে সাধারণ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এক ধরনের বাজারি ছবির প্রচলনও হয়তো ছিল, কিন্তু সঙ্গত কারণেই সে ছবির উপকরণ-মাণ এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ছিল উপেক্ষণীয়; তাই প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে সে ছবির চরিত্র বিশ্লেষণের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।

ঊনবিংশ শতকে ‘ব্রিটিশ রাজ’ প্রতিষ্ঠার প্রকল্প এই রীতিটাকেই বদলে দিয়েছিল। ব্রিটিশরা চেয়েছিল ভারতের ‘নেটিভ’দের ব্রিটিশ রাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে, আফ্রিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে উপনিবেশগুলোর মতোই ভারতবর্ষের অধিবাসীদেরও তারা মনে করতো শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অনগ্রসর, পশ্চাদপদ আর এদেরকে ‘সভ্য’ করে তোলার মহান দায়িত্ব তাদের কাঁধে ছিল বলেই তারা প্রচার করতো। এই প্রকল্পেরই অংশ হিসেবে উনিশ শতকে ব্রিটিশ আদলে ঢেলে সাজানো হয়েছিল ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাকে, সেই সূত্র ধরে বদলে গিয়েছিল শিল্পকলা চর্চার ধারাটিও। কোম্পানির কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আর্ট

স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এর আগেই, সেই স্কুলের সরকারিকরণ ও পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হয়েছিল ‘রাজ’ প্রতিষ্ঠার ব্রতকে সামনে রেখেই। সেই সব স্কুলের ব্রিটিশ পাঠ্যক্রমে শিক্ষিত শিল্পীদের মাথাতেই এরপর উঠেছে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট, পৃষ্ঠপোষকের রুচি বদলের সূত্র ধরে তাঁদের সৃষ্ট শিল্পকর্ম পেয়েছে ‘আধুনিকতা’র তকমা। বাংলার শিল্পকলা, বিশেষ করে চিত্রকলায় ‘আধুনিকতা’র এই ধারণাটি ঔপনিবেশিক হিসেবেই বিবেচ্য, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় ঔপনিবেশিক যুগাবসানের সাত দশক পেরিয়ে গেলেও সেটি খুব একটা বদলায়নি।

সাম্প্রতিককালের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী অবশ্য আধুনিকতা আর ঔপনিবেশিকতার ধারণাকে অনেকটা সাংঘর্ষিক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ভিন্ন কোনো দেশের প্রশাসন যখন কোনো একটি অঞ্চল বা সেই অঞ্চলের মানুষের ওপর জোরপূর্বক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, সরল বিবেচনায় সেটিকেই ঔপনিবেশিকতা বিবেচনা করা হয়। ঔপনিবেশিকতার চরিত্র নিয়ে বিশেষ করে গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সমাজবিজ্ঞানীরা অনেক রকম বিশ্লেষণই করার প্রয়াস পেয়েছেন। সে সকল বিশ্লেষণের সার সংক্ষেপ হিসেবে বলা যায়,

ঔপনিবেশিক শাসকদের এই সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটিই প্রতিফলিত হয়েছে বাংলা তথা ভারতবর্ষের শিল্পকলার ওপর ব্রিটিশদের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীতে। ‘আধুনিকতা’ সেই অর্থে একটি পৃথক বিষয় কিন্তু এ দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন অনেকেই। শিল্প- বিপ্লবের সূত্র ধরে ইউরোপে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যে জোয়ার শুরু হয়েছিল, তা অনেকটাই বদলে দিয়েছিল মানব সমাজের চরিত্র। ইঞ্জিন-চালিত যোগাযোগ মাধ্যম, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা ও শিল্প-কারখানার বিকাশ বিপুলসংখ্যক গ্রামবাসীকে করে তুলেছিল নগরমুখী, মানুষের জীবন-যাত্রায় হঠাৎ করেই আসতে শুরু করেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তিত জীবন-ব্যবস্থাকেই সংক্ষেপে আধুনিকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই পরিবর্তন অনিবার্যভাবেই প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনকে। উনিশ শতক থেকেই তাই বিশেষ করে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মধ্যে এই ধারণা প্রবল হতে শুরু করেছিল যে, যুগ যুগ ধরে চলমান শিল্পকলা, স্থাপত্য, সাহিত্য, দর্শন, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং এমনকি মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পর্যন্ত শিল্পায়নের ধাক্কায় এগিয়ে যাওয়া নয়া অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে মানানসই নয়, এগুলোকে বদলে ফেলতে হবে। আধুনিকতার ধারণাটি তাই প্রকৃতপক্ষে শিল্প-সাহিত্যের জগৎকেই নাড়া দিয়েছে সবচেয়ে বেশি।

সঙ্গে ইউরোপের যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য। উনিশ শতক থেকে শুরু করে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউরোপীয়রা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের ওপর ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। রাজনৈতিক এ আধিপত্যের সূত্র ধরে অনিবার্যভাবেই প্রভাবিত হয়েছিল উপনিবেশগুলোর সমাজ ও সংস্কৃতি, তাতে এসেছিল পরিবর্তনের ছোঁয়া। ইউরোপীয় আধুনিকতার ধারণাটি এভাবেই প্রবেশ করেছিল উপনিবেশগুলোতে, ব্যতিক্রম ছিল না বাংলাও।

পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে ক্যালকাটা আর্ট স্কুল বা আর্ট স্টুডিওর যুগে উত্তরণ নিঃসন্দেহে এক দীর্ঘ পরিক্রমার ফসল। ব্রিটিশ শাসন শুরুর আগে এই অঞ্চলে শিল্পচর্চার সবচেয়ে জোরালো ধারাটি ছিল দরবারকেন্দ্রিক, শাসক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় যেখানে ওস্তাদ শিল্পীদের তত্ত্বাবধানে কাজ করতে করতে শিখতেন নবীন শিল্পীরা। এর বাইরে ছিল তথাকথিত ‘বাজারি’ শিল্পকলা, গ্রামবাংলার লোকশিল্পীরা যা আঁকতেন সাধারণ মানুষের জন্য। সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথায় পটুয়া হিসেবে পরিচিত এই শিল্পীকুলের অবস্থান মোটেই সম্মানজনক ছিল না, তাঁরা বিবেচিত হতেন সমাজের একেবারে নিম্নতম শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে। দিল্লীর বাদশাহ আকবর প্রথম এই শ্রেণিভেদ প্রথার উর্ধে উঠে মেধার ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগ আসলে ছিল খুবই সীমিত, তাই আঠারো শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকেও বাংলায় শিল্পীসমাজের সামাজিক অবস্থানের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। এমনিতেই ‘নেটিভ’দের সম্পর্কে এক ধরনের উন্নাসিকতা ছিল ব্রিটিশদের, শিল্পীদের ক্ষেত্রে সেটা আরো জোরালো হয়েছিল নিজেদের সমাজেই তাদের নিম্ন অবস্থানের কারণে। আঠারো শতকেই ইংল্যান্ডে শুরু হয়ে গিয়েছিল একাডেমিক আর্টের বিপ্লব। লন্ডনের বিখ্যাত সাউথ কেনসিংটন স্কুলকে ঘিরে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, চোখে যা দেখা যায় তার হুবহু প্রতিচ্ছবি অংকনের রীতি ‘একাডেমিক রিয়েলিজম’ পরিচয়ে পৌঁছেছিল গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত পর্যায়ে। বাংলার শিল্পীরা এই ধারায় অভ্যস্ত ছিলেন না। সেটা যে কতটা অপছন্দ ছিল ব্রিটিশদের, তার খানিকটা ধারণা পাওয়া যায় ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জেমস মিলের কথায়। ১৮১৭ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ভারতবর্ষের শিল্পকলা ছিল ‘আদিম পর্যায়ের’,

করেছেন বিজ্ঞানসম্মত শিল্পভাষা শিক্ষার অভাবকে, সে কারণেই ভারতের শিল্পীরা প্রকৃতিকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না।

কিন্তু প্রশিক্ষণ পেলে যে ভারতীয় শিল্পীরাও সেটা করতে পারতেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আঠারো শতকের শিল্পী সীতা রামের অঙ্কিত চিত্রকর্মসমূহ প্রমাণ করে যে, মিলের এই বর্ণনা লিপিবদ্ধ করার আগেই ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে অন্তত কেউ কেউ একাডেমিক রিয়েলিজমের ব্যবহার শিখে ফেলেছিলেন। তবে সীতা রাম ঠিক কি ভাবে তা শিখেছিলেন, তার পরিপূর্ণ ইতিহাস জানা যায়নি।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের পরিকল্পক লর্ড মেকলের ভাবনাতেও ছিল মিলের এই ধারণারই প্রতিচ্ছবি। ১৮৩৫ সালের বিখ্যাত মেকলে মিনিটস-এ তিনি ভারতবর্ষের নেটিভদের ব্রিটিশ কায়দায় শিক্ষা দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের অনুগত এবং সরকারের কাজে সাহায্য করতে পারবেন এমন একটি শ্রেণি সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।”

মিল-মেকলেদের এই চূড়ান্ত ঔপনিবেশিক ভাবনার ফসল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ একাডেমিক রীতির শিল্পশিক্ষার প্রসার। । লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপটি নেয়া হয়েছিল ১৮৩৯ সালে। ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে ইন্ডিয়া রিভিউ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ফ্রেডারিক করবিনের উদ্যোগে সংগঠিত একদল শিল্পরসিকের পৃষ্ঠপোষকতায় মেকানিক্যাল ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এ উদ্দেশে গঠিত কমিটিতে ব্রিটিশদের পাশাপাশি ছিলেন স্থানীয় ‘ভদ্রলোক’ সমাজের প্রতিনিধিরাও। পিটার গ্র্যান্ট ছিলেন এই কমিটির সভাপতি, খ্যাতিমান শিল্পী কোলসওয়ার্দি গ্র্যান্ট অন্যতম যুগ্মসচিব আর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক তারাচাঁদ চক্রবর্তী। ‘এদেশীয়দিগকে শ্রমজাত শিল্প’ শিক্ষা প্রদান ছিল এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, তবে মেকলের পরামর্শের সূত্র ধরে ১৮৫৪ সালে কলকাতায় সরকারি উদ্যোগে ‘কলকাতা স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ধারা বেগবান হতে থাকে। পরবর্তী এক যুগের মধ্যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট শেখানোর মোট ২২টি স্কুল স্থাপিত হয়। এর মধ্যে কলকাতারটি ছাড়াও দুটি বড় স্কুল ছিল মুম্বাই (তখনকার বম্বে) এবং চেন্নাই (তখনার মাদ্রাজ) শহরে। ১৮৭৮ সাল নাগাদ এ রকম আরেকটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় লাহোরে। এই ভুলগুলি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় মাদ্রাজ স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট আলেকজান্ডার হান্টার এবং মাদ্রাজের ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশনস ই.বি. পাওয়েলের পরস্পরকে লেখা কয়েকটি চিঠি থেকে। ১৮৬৭ সালের এই চিঠি-চালাচালি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, স্কুলগুলি প্রতিষ্ঠার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের অনুগত একদল ‘কর্মী’ গড়ে তোলা, যারা সরকারের প্রয়োজনে ভূমি-জরীপ থেকে শুরু করে স্থাপত্য নির্মাণের মতো নানা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় নকশা আঁকতে পারবেন। হান্টার তাঁর চিঠিতে ব্রিটিশ সরকারের ড্রাফটসম্যান হিসেবে কাজ করতে পারবে, এ রকম একদল শিল্পী গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি পাঠ্যক্রম প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি তুলে ধরেছিলেন এই ধরনের একদল দক্ষ কর্মীর প্রয়োজনীয়তার কথাও।

এই পাঠ্যক্রমের সাফল্য নিয়ে অবশ্য আপত্তি ছিল অনেকেরই, এক সময় দাবি উঠেছিল এই ভুলগুলো করে দিয়ে সাধারণ কারিগরী শিক্ষায় আত্মীকৃত করে নেয়ার। তবে হান্টারের মতো কেউ কেউ আশা ছাড়েননি। অন্য একটি চিঠিতে পাওয়েলকে তিনি লিখেছেন, ‘ওঃ রং ডুৎ নড়হফবহ ফন্তু গড় ফরৎবপঃ ধহফ রহংঃৎপঃ ঃযব ঢ়ঢ়রষং ধৎমযঃ।’ শেষ পর্যন্ত তাঁদের যুক্তিরই জয় হয়েছে, আর্ট স্কুলের জন্য সরকারি স্বীকৃতি ও অর্থায়ন বন্ধ হয়নি।

উল্লেখিত অন্যান্য আর্ট স্কুলের মতো কলকাতার স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সোসাইটি ফর দি প্রমোশন অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’ নামে একটি জন-হিতৈষী সংঘের উদ্যোগে। এই সংঘের সদস্যদের চাঁদার টাকায় বিদ্যালয়ের খরচ কুলিয়ে ওঠা সম্ভব না হলে সরকারের কাছে দেন-দরবার করে মাসিক ছয়শত টাকা মঞ্জুরি আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের আগে গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের সৌজন্যে পাওয়া এই অনুদান অবশ্য যুদ্ধের পর কমে দাঁড়িয়েছিল মাসিক সাড়ে তিনশত টাকায়। ১৮৬৪ সালে বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণভাবে অধিগ্রহণ করে সরকার। অধিগ্রহণের শর্ত অনুযায়ী লন্ডনের সাউথ কেনসিংটন মিউজিয়ামের স্কুল অফ ডিজাইনের (সাধারণভাবে কেনসিংটন স্কুল নামে পরিচিত) প্রাক্তন শিক্ষার্থী হেনরি হোভার লককে অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। ১৮৬৪ থেকে ১৮৮২ পর্যন্ত অধ্যক্ষ থাকাকালে লকই মূলত এই স্কুলের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করেন। এ পাঠ্যক্রমের অংশ ছিল

ক. রেখাঙ্কন

খ. চিত্রাঙ্কন

গ. মডেলিং এবং মৃৎশিল্প

ঘ. কারুধর্মী নকশা (নির্মাতাদের উপযোগী ডিজাইন প্রণয়ন)

ঙ. লিথোগ্রাফি

চ. কাঠখোদাই এবং

ছ. ফটোগ্রাফি

‘নেটিভ’ শিল্পীদের সৃজনশীলতা ছিল না, এই যুক্তিতেই ভারতবর্ষের শিল্পকলাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়ার পক্ষে ছিলেন ব্রিটিশ শিল্পবোদ্ধারা; কিন্তু আর্ট স্কুলের উল্লেখিত পাঠ্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে প্রকৃতপক্ষে এই পাঠ্যক্রমেও সেই সৃজনশীলতার বিকাশের ওপর মোটেই জোর দেয়া হয়নি। এই পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুসমূহ এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যেন শিক্ষার্থীরা দৃশ্যমান বস্তুকে যথাযথ অনুকরণ করতে এবং ব্যবহারিক ছবি ও নকশা আঁকতে পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে।

ব্রিটিশদের এই ঔপনিবেশিক শিক্ষা নীতির ফল হয়েছিল দুই রকম। প্রথমত, এর ফলে এক দল দক্ষ ড্রাফটসম্যান তৈরি হয়েছিল, সরকারের সার্ভে অফিস আর প্রিন্টিং প্রেসগুলোর শিল্পী হিসেবে কাজ করতে পারতেন যারা। তবে এই পরিবর্তনের চাইতেও বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল শিল্পী মানসের পরিবর্তন। ভারতবর্ষের শিল্পীরা বংশ পরম্পরায়, আর সেই পরম্পরা অনুসারে শিল্পীরা ছিলেন বর্ণাশ্রিত সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ। আধুনিক শিল্প শিক্ষার ব্যবস্থা এই পরম্পরা ভেঙে নতুন এক শিল্পী সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছিল, যারা নিজস্ব স্টুডিও গড়ে স্বাধীনভাবে শিল্পচর্চা করতে শুরু করেছিলেন। এমন নয় যে সামাজিক স্তরবিন্যাসে খুব বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেছিল তাদের, ব্রিটিশ সরকারের অধীনে যে সব চাকরি পেতেন তাঁরা সেগুলোও খুব সম্মানজনক ছিল না।” কিন্তু নিঃসন্দেহে তাঁদের আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল এই শিক্ষা।

তাদের এই আত্মবিশ্বাসের নেপথ্যে ছিল ইউরোপীয় ধারার শিল্পকলা চর্চার বিকাশ। ব্রিটেন থেকে আগত কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যে তো বটেই, কলকাতার বিত্তশালী ‘ভদ্রলোক’দের মধ্যেও এ ধরনের শিল্পকলা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছিল। এর ধারাবাহিকতায় কলকাতায় শুরু হয়েছিল ইউরোপীয় স্টাইলের চিত্র প্রদর্শনী। ১৮৩১ সালেই এ ধরনের প্রথম প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছিল’, যদিও সেখানে স্থান পেয়েছিল মূলত কেটল, চিনারি, হজেস, জোফানিদের মতো ব্রিটেন থেকে আগত অতিথি চিত্রকরদের কাজ, সঙ্গে ছিল ইংল্যান্ডের রয়‍্যাল একাডেমীর খ্যাতিমান চিত্রকর স্যার জশুয়া রেনল্ডস, স্যার হেনরি বোর্ন, বেঞ্জামিন ওয়েস্ট এবং জর্জ মুরল্যান্ডের আঁকা ছবি। পরের বছরও এ রকম আরেকটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল, কিন্তু এ দুটি প্রদর্শনীর কোনোটিতেই স্থান পায়নি কোনো বাঙালি বা ভারতীয় চিত্রকরের ছবি। কিন্তু প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশ কিছু ছবির স্পনসর হিসেবে ছিলেন বাঙালিরা।

আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে এ রকম প্রদর্শনীতেও জায়গা পেতে শুরু করেন বাঙালি শিল্পীরা। পরবর্তী কালে, ১৮৫৪-৫৫ এবং ১৮৭৪ সালে আয়োজিত দুটি প্রদর্শনীতেই ছিল বাঙালি শিল্পীদের কাজ। বিশেষ করে ১৮৭৪ সালের প্রদর্শনীটিতে তো কলকাতার তিন শিল্পী আনন্দ প্রসাদ বাগচী, হরিশচন্দ্র খান এবং গিরিশ চন্দ্র চ্যাটার্জির আঁকা ছবি বিশেষভাবে মনযোগ আকর্ষণ করেছিল। এই তিনজন ছাড়াও কলকাতা ও বোম্বে আর্ট স্কুলের এদেশীয় ছাত্র-শিক্ষকদের আরো অনেকেরই ছবি স্থান পেয়েছিল এই প্রদর্শনীতে। এগুলোর বেশির ভাগই আসলে ছিল শ্রেণিকক্ষের অনুশীলনমূলক কাজ, যেমন লিথোগ্রাফি বা উড এনগ্রেভিংয়ের সাহায্যে করা ছাপচিত্র এবং বিশেষ করে প্রতিকৃতি। তবে এই কাজগুলো থেকেই ধারণা পাওয়া যায় যে ওই সময়ের আর্ট স্কুলে হাতে-কলমে ঠিক কী ধরনের শিক্ষা দেয়া হতো। কোম্পানি আমলে ইউরোপ থেকে আসা চিত্রকরদের আঁকা ছবির মতোই এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া এদেশীয় শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে ছিল মডেল দেখে আঁকা প্রতিকৃতি, যেগুলোর শিরোনাম ছিল, পুরোহিত, দারোগা, ঢাকী, চাপরাশি কিংবা বাবুর্চি। অর্থাৎ তাদের মূলত শেখানো হতো বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, ঠিক যেমনটা করেছিলেন বালথাজার্ড সলভিনস, মিসেস বেলনোসরা। নতুন ধারার এই শিল্প শিক্ষা এবং তার সরকারি স্বীকৃতি বাঙালি শিল্পীদের সামাজিক উত্তরণ ঘটাতে না পারলেও তাদের এনে দিয়েছিল এক ধরনের সম্মান। এর প্রতিক্রিয়ায় নব্য ধারায় শিক্ষিত এই শিল্পীকূলের একটি অংশ মননে-মানসে ঔপনিবেশিক রুচিবোধদের ধারণ করতে শুরু করেছিলেন।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading