কবিকঙ্কণের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘বারোমাস্যা’ অংশে সতীন সমস্যা কেন্দ্রিক নারীর যে মর্মবেদনা
কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘বারোমাস্যা’ অংশে সতীন সমস্যাকেন্দ্রিক নারীর মর্মবেদনা গভীরভাবে চিত্রিত হয়েছে। এই অংশটি গ্রামীণ নারীদের মানসিক ও সামাজিক অবস্থার এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরে, যা মূলত তৎকালীন সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর প্রভাব প্রতিফলিত করে।
সতীন সমস্যা ও মর্মবেদনার প্রেক্ষাপট
বারোমাস্যা অংশে একজন গ্রামীণ নারীর জীবনের দ্বন্দ্ব, হতাশা, ও যন্ত্রণা বারো মাসের প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে একজন নারী তার সতীনের আগমনে সৃষ্ট অপমান, অবহেলা এবং স্বামীর প্রেম হারানোর বেদনা প্রকাশ করেন। সতীনের প্রতি স্বামীর পক্ষপাতিত্ব তাকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তোলে, এবং নিজের অস্তিত্বকেও সে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করে।
বেদনার বর্ণনা
কাব্যে সতীন সমস্যায় ভুক্তভোগী নারী বারো মাসের বিভিন্ন ঋতুকে নিজের দুঃখ-কষ্টের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন। উদাহরণস্বরূপ:
- শীত ঋতু: শীতের হিমশীতল বাতাস তার অন্তরের শূন্যতা ও একাকিত্বকে প্রকাশ করে। স্বামী যে আর তার প্রতি অনুরক্ত নন, তা তাকে প্রচণ্ড শীতের মতোই অসহনীয় লাগে।
- গ্রীষ্ম ঋতু: গ্রীষ্মের প্রখর রোদ তার অন্তরের জ্বলন্ত অশান্তির সঙ্গে তুলনীয়, যা সতীনের প্রতি স্বামীর ভালোবাসা দেখে আরও তীব্র হয়।
- বর্ষা ঋতু: বর্ষার অঝোর বৃষ্টি তার অন্তরের অশ্রুপ্রবাহের প্রতীক। স্বামীর অবহেলা ও নিজের হতাশা তার জীবনকে এক অবিরাম শোকের ধারায় পরিণত করেছে।
সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
সতীন সমস্যার কারণে নারী কেবল মানসিক যন্ত্রণা নয়, সামাজিকভাবে অপমানিতও হন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে স্বামীর ভালোবাসাই ছিল নারীর সম্মান ও সামাজিক মর্যাদার প্রধান ভিত্তি। স্বামীর অবহেলায় নারী নিজেকে সমাজে নিঃস্ব এবং অপ্রয়োজনীয় মনে করত। এ ধরনের পরিস্থিতি নারীর আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসকে চূর্ণ করত।
সতীন ও প্রধান স্ত্রীর সম্পর্কের দ্বন্দ্ব
বারোমাস্যা অংশে প্রধান স্ত্রীর মনে সতীনের প্রতি ঈর্ষা, ঘৃণা এবং কখনো কখনো নিজের দুর্বলতার প্রতি অপরাধবোধের কথা ফুটে উঠেছে। তিনি সতীনকে নিজের সুখ এবং সংসারের শান্তি হরণকারী হিসেবে দেখেন। তবে এই দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া, যা নারী চরিত্রের জটিলতাকে চিত্রায়িত করে।
কাব্যের মানবিকতা
মুকুন্দ চক্রবর্তীর এই অংশের বর্ণনা শুধু সতীন সমস্যা নয়, বরং নারীর গভীর মানসিক জগৎ, তার বেদনা, আকাঙ্ক্ষা, এবং সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে। নারীর দুর্বলতা এবং কষ্ট শুধু ব্যক্তিগত নয়, তা বৃহত্তর সমাজের নারীর জীবনধারার প্রতীক।
উপসংহার
‘চণ্ডীমঙ্গল‘ কাব্যের ‘বারোমাস্যা‘ অংশ সতীন সমস্যাকেন্দ্রিক নারীর মর্মবেদনা কেবল তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট নয়, বরং সর্বজনীন মানবিক অনুভূতির প্রতিফলন। নারীর যন্ত্রণা প্রকৃতির বিভিন্ন রূপের সঙ্গে তুলনা করে কবি কাব্যটিকে এক গভীর মানবিক মাত্রা প্রদান করেছেন, যা আজও পাঠকের হৃদয়ে অনুরণন তোলে।