‘কাব্যং গ্রাহ্যম্ অলংকারাৎ’ — এই সংস্কৃত বাক্যটির অর্থ হলো:
“কাব্যকে গ্রহণ করতে হবে তার অলংকার (শিল্পগুণ বা অলংকারচর্চা) দেখে নয়, তার সারবস্তুর ভিত্তিতে।”এটি এক ধরনের সাহিত্যিক মুল্যবোধের কথা বলে, যেখানে অলংকার (অলঙ্করণ, চমৎকার শব্দ বা শব্দচাতুর্য) নয়, বরং কাব্যের অভিপ্রায়, ভাব, রস, ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য মুখ্য হয়ে ওঠে।
🔶 ১. অলংকার বনাম কাব্যের সারবস্তু
• ‘অলংকার’ বলতে বোঝায়: চিত্রকল্প, শব্দচাতুর্য, উপমা, রূপক, শ্রুতি-মাধুর্য ইত্যাদি।
• কিন্তু শুধু অলংকার থাকলেই কাব্য সফল হয় না, যদি তা অন্তঃসারশূন্য হয়।
• এই উক্তির মাধ্যমে বোঝানো হয়:
কাব্যের অন্তর্নিহিত ভাব, মানবিক আবেদন, ও রসাস্বাদনই প্রধান। অলংকার কেবল তার বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
🔶 ২. ভামহ, দণ্ডি ও রুদ্রটের মতবিরোধ
এই বিষয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষভাবে আলোচ্য তিনজন নন্দনতত্ত্ববিদের মত তুলে ধরা যায়:
• ভামহ বলেছেন, “অলংকারো কাব্যলক্ষণম্” – অর্থাৎ অলংকারই কাব্যের প্রধান লক্ষণ।
• দণ্ডি বলেছিলেন, কাব্যে অলংকার থাকা উচিত, তবে তা প্রধান নয়।
• রুদ্রট এই বিতর্ককে এগিয়ে নিয়ে এসে বলেন —
“কাব্যং গ্রাহ্যম অলংকারাৎ” — অর্থাৎ অলংকার থাক বা না থাক, কাব্যের আসল উদ্দেশ্য হলো সারমর্মের উপলব্ধি।
এই মতই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, কারণ সত্যিকারের কাব্য পাঠককে মানবিক বোধে ছুঁয়ে যায়, অলংকার দিয়ে নয়।
🔶 ৩. উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা
• কাব্যে অলংকার থাকতে পারে, যেমন রচনার ঝলমলে শব্দ বা কাব্যিক উপমা।
কিন্তু যদি তাতে ভাবের গভীরতা না থাকে, তাহলে তা অপ্রাণ, ফাঁপা সৌন্দর্য মাত্র।
• যেমন: কৃত্রিম গয়না যতই ঝলমলে হোক, তা সোনার মূল্য পায় না।
একটি সাধারণ অথচ হৃদয়গ্রাহী কবিতা (যেমন: রবীন্দ্রনাথের “সহজপাঠ”-এর কিছু কবিতা), কখনও কখনও অলংকারবিহীন হয়েও পাঠকের হৃদয় জয় করে।
কারণ: তা ভাববস্তুর প্রাঞ্জলতাকে তুলে ধরে।
🔶 ৪. এই উক্তির তাৎপর্য
এই বাক্যটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে—
• কাব্য বা সাহিত্য বিচার করতে গেলে বাহ্যিক কারুকার্য নয়, অন্তর্গত সত্য, ভাব, ও মননকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
• অলংকার না থাকলেও, যদি কাব্যে রস, মানবিকতা, নৈতিক আবেদন থাকে, তবে সেটাই যথার্থ কাব্য।
🔶 উপসংহার
‘কাব্যং গ্রাহ্যম্ অলংকারাৎ’ — এই উক্তি কাব্যবিচারের একটি গভীর নৈতিক ও নান্দনিক দর্শন।
এটি বলে দেয়, সাহিত্যে অলংকার গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তা উদ্দেশ্য নয়—উপাদান মাত্র।
আসল কাব্য সেখানে, যেখানে ভাবের গভীরতা, অনুভবের সত্যতা, ও মানবিক উপলব্ধি রয়েছে।