উত্তর বাংলার ইতিহাসে গৌড় অধিপতি শশাঙ্ক অকস্মাৎ উল্কাপিন্ডের মতো উদিত হয়ে কিছু সময়ের জন্য আপন কৃতিত্বের দ্বারা সমকালীন ইতিহাসে আলো ছড়িয়ে দেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, “শশাঙ্ক তাঁর রাজ্য জয় দ্বারা যে নীতির পত্তন করেন, তা অনুসরণ করে পাল রাজারা এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।” আর্যাবর্তে বাঙালি সাম্রাজ্য বিস্তারের কল্পনা সর্বপ্রথম তাঁর মনেই উদিত হয়েছিল এবং তাঁর চেষ্টায় এই কল্পনা আংশিকভাবে বাস্তবে রূপায়িত হয়েছিল।
অতি সামান্য এক অজ্ঞাত অবস্থা থেকে শশাঙ্ক নিজ যোগ্যতার জোরে ভারত ইতিহাসের পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাঁড়ান। যদিও তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক উপাদান খুবই কম, যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় তা বিরোধী পক্ষের লেখনী থেকে। বাণভট্ট-এর মতানুসারে “He had no well wisher court poet.” তবুও রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে তাঁর জীবন যে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর বংশপরিচয় অজ্ঞাত থাকা সত্বেও তিনি প্রমাণ করেছিলেন অতীত যাইহোক আপন বাহুবলে এবং অধ্যবসায়ে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বাংলা ছিল কাব্যে উপেক্ষিতার মতোই। উত্তর ভারতীয় শক্তিসমূহ বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করে এসেছিল কিন্তু বাংলাও যে উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে এ কথা কেউ ভাবতে পারেনি। শশাঙ্কই সর্বপ্রথম ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দেন। তিনি অন্তত কিছুদিনের জন্য বাংলাকে এক সর্বভারতীয় শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। কনৌজের মৌখরী বংশকে ধ্বংস করে পূর্ব ভাগে ভাস্করবর্মনকে পদানত করে শশাঙ্ক বিজয়লাভ করেন। দক্ষিণে গঙ্গা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে তিনি বাংলার চারদিকে প্রাকৃতিক সীমান্ত পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তার করেন। কনৌজ-গৌড় সংগ্রামের পত্তন করে তিনি পালরাজাদের জন্য পথনির্দেশ করে যান।
দুঃসাহসী বীর হিসেবে শশাঙ্ক পরিচিতলাভ করলেও তিনি একইসঙ্গে সুশাসকও ছিলেন। তাঁর শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও তিনি যে একজন প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন তা অনুধাবন করা যায়, কারণ তাঁর সময় রাজধানী কর্ণসুবর্ণ সম্পদময়ী নগরীতে পরিণত হয়েছিল। তিনি গৌড়ে শুধুমাত্র মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেননি, তার স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গঠনের আয়োজনও করেছিলেন। মেদিনীপুরের দাঁতন বা দণ্ডভুক্তি অঞ্চলে ‘শশাঙ্ক দীঘি’ জলসেচ ব্যবস্থার জন্য তাঁর প্রচেষ্টার সাক্ষ্য দেয়। চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের বিবরণে শশাঙ্কের সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার যে ধারণা পাওয়া যায় তা থেকে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতারই পরিচয় পাওয়া যায়। প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণমুদ্রা এই সময়ে চালু হয়েছিল। শশাঙ্কের পরবর্তীকালে বাংলায় আর কোনো স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল না।
হিউয়েন সাং তাঁর বিবরণে বাংলার জনপদগুলির কয়েকটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পরিবেশন করেছিলেন। যেমন-কজঙ্গল বা উত্তর-পশ্চিমবঙ্গের জমি কৃষির পক্ষে অত্যন্ত উপযুক্ত ছিল, কারণ আবহাওয়া ছিল আর্দ্র ও উয়। পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গের জনসাধারণের অবস্থা সচ্ছল ছিল এবং হিউয়েন সাং যেখানে সর্বত্র পুকুর, উদ্যান, সরাইখানা দেখেছিলেন, পরবর্তীকালে তিনি সেখানে 20টি বৌদ্ধবিহার এবং 3000-এর অধিক হীনযান ও মহাযান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেখেছিলেন। শশাঙ্কের আমলে সমাজে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। সমাজে বিভিন্ন
শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি থাকলেও সবচেয়ে সম্মানিত ছিলেন ব্রাহ্মণ শ্রেণি। শশাঙ্কের তাষ শাসনগুলিতে দেখা যায় যে, পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণদের ভূমি এবং কোনো কোনো সময়ে গ্রাম দান করা হয়েছে। সমাজে কর্মচারী শ্রেণির গুরুত্ব ছিল। তাম্রশাসনে পঞ্চায়েত বোর্ড জাতীয় যে সংস্থার কথা আছে তাতে 35 জন সদস্যের মধ্যে মহত্তর, মহামহত্তর, প্রধান, পুস্তপাল করণিক প্রভৃতি সরকারি কর্মচারীর নাম উল্লেখিত আছে। সমাজে নিম্নশ্রেণির মর্যাদা একটু কমই ছিল। কারণ দেখা যায় চন্ডালদের পৃথক পুষ্করিণী ছিল। যদিও জমিতে তাদের স্থায়ী অধিকার ছিল। না হলে পুষ্করিণী খনন করা অসম্ভব হত।
ইতিহাসের নির্মম পরিহাস এই যে, তাঁর সময় বাণভট্ট বা হিউয়েন সাঙের মতো কোনো সহানুভূতিশীল বা শুভাকাঙ্ক্ষী জীবনীকার ছিল না। এজন্য তাঁর কীর্তি কাহিনির সকল কথা আমাদের অজানার মধ্যেই রয়ে গেছে। শশাঙ্কের ব্যক্তিগত চরিত্র অনেকটা বিরোধী লেখকদের অতিরঞ্জনে কালিমালিপ্ত হয়েছে। তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজ্যবর্ধনরে তো করেন বলা হয়, আবার বৌদ্ধ নির্যাতনকারী বলেও তাঁকে দায়ী করা হয়। এর জন্য অবশ্য শশাঙ্কের ধর্মান্ধ নীতি বা বৌদ্ধবিদ্বেষ দায়ী ছিল না। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে শশাঙ্ক তাঁর শত্রুদের দমন করেছিলেন। যাইহোক না কেন, পরিশেষে নিশ্চিতভাবে এ কথা বলা যায় যে শশাঙ্ক বাংলায় যে নতুন ধরনের শাসন নীতির প্রবর্তন করেছিলেন তাকে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় ‘গৌড়তন্ত্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।