গৌড়বঙ্গ নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান দেশ হলেও শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় আনুকূল্যের অভাব ছিল না। শিল্পের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন উৎস থেকে কৃষিজ পণ্য, যেমন-কার্পাস, ইক্ষু ইত্যাদি; বনজ, যেমন-কাঠ: খনিজ এবং বিভিন্ন প্রকার ধাতু এবং জলজ, যেমন-মৎস্যাদি, প্রাণী এবং সমুদ্রোপকূলস্থ অঞ্চলে প্রাপ্ত মূল্যবান প্রস্তরাদি। যদিও সব কাঁচামাল সব জায়গায় সুলভ ছিল না। বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ শিল্প উপযোগী কাঁচামাল পাওয়া যায়, আর যেটুকু সম্পদ এতদঞ্চলে শিল্পীরা পেয়েছিলেন তার যথোচিত ব্যবহারের দ্বারা তাঁরা বাংলার শিল্পকে ক্রমবিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।
প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগে বাংলায় যেসব শিল্প সমৃদ্ধিলাভ করেছিল তার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য ছিল বয়ন শিল্প। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে চার প্রকার বস্ত্র উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, ‘ক্ষৌম’-মোটা ধরনের লিনেনের সঙ্গে সুতির মিশ্রণে উৎপন্ন ক্ষৌম বস্ত্রের প্রধান কেন্দ্র ছিল পুণ্ড্রবর্ধন ও বারাণসী। দ্বিতীয়ত, ‘দুকুল’-সূক্ষ্ম-লিনেনের তৈরি দুকূলের উৎপাদন কেন্দ্র ছিল বঙ্গ, পুণ্ড্র এবং কামরূপের সুবর্ণকুড়া। তৃতীয়ত, ‘পত্রোর্ন’- বন্যজাত রেশম বা সিল্ক। চতুর্থত, ‘কাপাসিক’-কার্পাস তুলা জাত সুতি থেকে বস্তুবয়ন করা হত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বিশেষত বঙ্গে।
গৌড় বঙ্গের বস্তুবয়ন শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে খ্যাতিলাভ করেছিল। ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ থেকে জানা যায়, বঙ্গ থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি করা হত, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মসলিন। পঞ্চদশ শতাব্দীর মা-হুয়ানের বিবরণ থেকে জানা যায় যে সেকালে বাংলায় পাঁচ-ছয় প্রকার বস্ত্রবয়ন প্রচলিত ছিল।
• শর্করা শিল্প: বয়ন শিল্পের পরেই স্থান ছিল শর্করা শিল্পের। সুশ্রুত বালেছেন যে, পুণ্ড্রদেশে এক বিশেষ জাতের ইক্ষু উৎপাদন হয়, যার নাম ‘পৌণ্ড্রক’। এই ইক্ষুর রস থেকে উৎপন্ন হত গুড় এবং তা থেকে প্রস্তুত হত শর্করা বা চিনি। মার্কোপোলের বিবরণে বলা হয়েছে বাংলার রপ্তানিযোগ্য পণ্যদ্রব্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চিনি।
• লবণ শিল্প: প্রাপ্ত লেখমালার সাক্ষ্যে অনুমান করা যেতে পারে যে, খনি থেকে লবণ উত্তোলিত হত। ইরদা তাম্রশাসনে বর্ধমান ভুক্তির অন্তঃপাতী দণ্ডভুক্তি মন্ডলের অন্তগর্ত একটি গ্রাম ‘লবণাকার’ সহিত দানের কথা বলা হয়েছে। আবার শ্রীচন্দ্রের রামপাল তাম্র-শাসনে এবং ভোজবর্মনের বেলাব তাম্রশাসনে লবণ সহিত একাধিক গ্রাম দানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
• মৃৎশিল্প: মৃৎশিল্পে ছিল বাংলার চিরায়ত উত্তরাধিকার। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৃৎশিল্প নিদর্শনকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়- তৈজসপত্র এবং চ পোড়ামাটির ফলক। পাহাড়পুরে খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দীর তৈজসপত্রাদি আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে ছিল বৃহদাকার পাত্র যাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঞ্চয় করা হত, লোটা বা ঘটি, রান্নার বাসনপত্র, বড়ো থালা, ঢেউ খেলানো থালা, কালির দোয়াত, প্রদীপ প্রভৃতি। এগুলি মঠবাসী ভিক্ষুরা ব্যবহার করতেন বলে মনে হয়। দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত মৃৎশিল্পের নিদর্শন অর্থাৎ পোড়ামাটির ফলক বাংলার বিভিন্ন প্রত্নস্থলে আবিষ্কৃত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহাস্থান, সাভার, পাহাড়পুর, চন্দ্রকেতুগড়, তাম্রলিপ্ত এবং মঙ্গালকোট। এইসব মৃৎফলক বাংলার টেরাকোটা শিল্পের অগ্রগতির পরিচায়ক। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কুস্তকার জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। মৃৎশিল্পই ছিল কুস্তকার জাতির একমাত্র অবলম্বন।
• ধাতু শিল্প: বাংলায় ধাতু শিল্প যথেষ্ট উন্নত ছিল। পাহাড়পুরে তিরের ফলা, বর্শার ফলা, তরবারি প্রভৃতি প্রচুর সংখ্যক যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। অভিন্ন পুরাণে বঙ্গে প্রস্তুত তরবারির বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। কেশব সেনের ইদিলপুর তাম্রশাসনে কৃষির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও লোহার পাত্রের উল্লেখও রয়েছে।
কেবল লোহা নয়, ব্রোঞ্চের ব্যবহারও শিল্পীরা জানতেন। গুপ্তযুগ থেকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বহুসংখ্যক ব্রোঞ্জ বা অষ্টধাতুর মূর্তি পাওয়া গেছে। কাজেই ব্রোঞ্জ ঢালাই করার কাজ শিল্পীরা বিচক্ষণ জানতেন। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে স্বর্ণকারদের উল্লেখ পাওয়া যায়। সোনা, রূপোর অলংকার নির্মাণ ছিল স্বর্ণকার জাতির বৃত্তি। বিষয় সেনের দেওপাড়া প্রশস্তি থেকে জানা যায় যে সরকারি কর্মচারীদের পত্নীরা। হার, দুল, মল, চুড়ি প্রভৃতি অলংকার ব্যবহার করতেন।
• তক্ষণ শিল্প: বাংলার অর্থনৈতিক জীবনে তক্ষণ শিল্প এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী ছিল। প্রথমেই উল্লেখযোগ্য প্রস্তর তক্ষণ শিল্প। এই শিল্পের নিদর্শন অসংখ্য প্রস্তর নির্মিত দেবদেবীর মূর্তি। এই মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে গৌড় বঙ্গের সর্বত্র। প্রস্তরী ফলকে উৎকীর্ণ করার কাজ করতেন তক্ষণ শিল্পীরা। রাজমহল পর্বত থেকে কৃষ্ণবর্ণের। ক্লোরাইট পাথর আমদানি করা হত।
দ্বিতীয়ত, দারু-তক্ষণ ছিল অন্যতম শিল্প। ঢাকার নিকট আরিয়াল নামক স্থানে একটি পুকুর থেকে দশফুট উঁচু ও দু-ফুট মোটা একটি কাষ্ঠস্তস্ত আবিষ্কৃত হয়েছে কাঠের উপর ভাস্কর্যের দৃষ্টান্ত রক্ষিত আছে ঢাকা মিউজিয়ামে। পাহাড় পুরে পাওয়া গেছে কাষ্ঠনির্মিত ঘরের আসবাবপত্র। চর্যাপদে নৌকা, জাহাজ ও চক্রযুক্ত রথ, গো-যান প্রভৃতির উল্লেখ আছে। বৃহস্বর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে জাতি তালিকায় সূত্রধর (দারু-তক্ষণের কাজ যারা করেন)-এর উল্লেখ আছে।
তৃতীয়ত, হস্তী-দস্ত তক্ষণ শিল্পও প্রচলিত ছিল। গোবিন্দ কেশবের ভাটেরা তাম্রশাসনে দস্তকারের উল্লেখ আছে। এখানে দস্তকার বলতে হস্তী-দস্ত তক্ষণ শিল্পীকে বোঝানো হয়েছে। কেশব সেনের ইদিলপুর, তাম্রশাসনে হস্তী-দন্ত নির্মিত দন্তযুক্ত পালকির উল্লেখ আছে।
• গৌণ শিল্প: সমাজে কিছু শিল্পী ছিলেন যাঁদের শিল্পকর্ম অন্যান্য শিল্পের তুলনায় গৌণ হলেও সমাজের পক্ষে অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। যেমন-শঙ্খ, শিল্প অবলম্বন করেছিলেন শাম্ভিক বা শাঙ্খকারেদের, মিষ্টান্ন শিল্প ছিল মোদকদের, পুষ্প শিল্প ছিল মালাকারদের, বৃত্তি, বস্তু রঞ্জিত করা রজকদের শিল্প। এইসব শিল্পীর উল্লেখ আমরা পাই বিভিন্ন জাতি হিসেবে বৃহদ্ধর্ম ও ব্রষ্মবৈবর্ত পুরাণে।
শিল্পোৎপাদনকারীরা বিভিন্ন বৃত্তি অবলম্বন করে পেশাগত জাতি নামে সাধারণত পরিচিত হতেন। আবার কখনো-কখনো এক-একটি বিশেষ শিল্পের অবলম্বনকারীরা গোষ্ঠী বা গিল্ডের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হতেন। খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীর তাম্রশাসনাদিতে ‘প্রথম কুলিক’ বারবার উল্লিখিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন কুলিক বা শিল্পীগোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। শিল্পীদের এই সংঘ বা গিল্ড গঠনের প্রবণতা পরবর্তীকালেও দেখা যায়। বিজয় সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিতে রাণক শূলপানিকে ‘বরেন্দ্রী-শিল্পী গোষ্ঠী- চূড়ামণি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এইসব গোষ্ঠী বা সংঘ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ অল্প সময়ের মধ্যে বর্ধিত করা, বৈচিত্র্য বাড়ানো এবং মান উন্নত করা।