চর্যাপদগুলির রচনার পটভূমিকা বিশ্লেষণ করে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদণ্ডলির স্থান নির্ণয় কর। চর্যাপদে প্রতিফলিত সমাজচিত্রের পরিচয় দাও।

আকস্মিকভাবে পৃথিবীর নূতন কোনও ভূখণ্ড আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে যেমন (পৃথিবীর মানচিত্র ও ইতিহাসের পরিবর্তন সাধিত হয়। অনুরূপ প্রাচীন একখানি গ্রন্থ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সমগ্র সাহিত্যের ইতিহাসকেও বদলে দিতে পারে। পুরাতন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমনই একটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। পর পর দু’খানি গ্রন্থ আবিষ্কারের ফলে সমগ্র বাংলা সাহিত্য ও ভাষা একটা দুর্জয় পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। এক, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ভজন-গীতিকা যা ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামে পরিচিত। আর একটি হোল বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। প্রথমটি যেমন আদি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন তেমন দ্বিতীয়টি মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন। এক কথায় উক্ত দুটি গ্রন্থের সন্ধান যদি না মিলতো পুরাতন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা দুরূহ হয়ে পড়তো। এই বিষয়ে যিনি কৃতিত্বের দাবী রেখেছেন তিনি হলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। প্রাচীন বাংলা ভাষা যখন সংস্কৃত প্রাকৃত স্তরকে অতিক্রম করে অবশেষে অপভ্রংশের জঠর থেকে জন্মগ্রহণ করছে সেই সময় বাংলা সাহিত্যের উষালগ্নে ২৪ জন কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সাধনতত্ত্বের গান, তা সাম্প্রতিক কালে ‘চর্যাগীতি’ নামেই খ্যাত।

চর্যাপদের আবিষ্কার:


সমগ্র প্রাচীন যুগের বালা সাহিত্যের ইতিহাসের জন্য যে একটিমাত্র গ্রন্থের উপরই আমাদের একান্তভাবে নির্ভর করে থাকতে হয়, সেটি ‘চর্যাপদ’। ১৯০৭ খ্রীঃ মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের পুঁথিশালা থেকে কিছু পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে এগুলিকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে প্রকাশ করেন (প্রকাশকাল ১৯১৬ খ্রীঃ)। শাস্ত্রী মহাশয় প্রাপ্ত গ্রন্থের যাবতীয় রচনার ভাষাকেই বাঙলা’ বলে মনে করলেও ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নিঃসন্দিগ্ধভাবে প্রমাণ করেন যে গ্রন্থস্থ বৌদ্ধগানগুলির ভাষা প্রাচীন বাঙলা হলেও দোহাগুলির ভাষা প্রাচীনতর অবহটঠ। উল্লেখ করা প্রয়ােজন, শাস্ত্রী মহাশয়ের আবিষ্কৃত পুঁথিগুলির মধ্যে চর্যাপদ ছাড়াও ছিল কৃষ্ণাচার্যের দোহা, সরহপাদের দোহা এবং ডাকার্ণব।

চর্যাপদের রচনাকাল


প্রাচীন বাংলা ভাষার অদ্বিতীয় নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ শুধু ধর্মের রহস্যেই ভরা নয়, তার রচনাকালও বিশেষ সংশয়যুক্ত। ভাষাতত্ত্বের প্রতিনিধি স্থানীয় পণ্ডিত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ সম্বন্ধে বিশেষ মতামত পোষণ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার তাঁর– ‘The Origin and Development of Bengali Language’ নামক গ্রন্থে এবং ড. প্রবোধ চন্দ্র বাগচী তাঁর ‘Dohakosa’ গ্রন্থে চর্যার রচনা সময় ১০ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যে চিহ্নিত করেছেন। ভাষাতত্ত্বের বিচারেও এর অনেক পদ ১২শ শতাব্দীর রচিত বলে মনে হয়।

আবার ড. শহীদুল্লাহ এবং পণ্ডিত রাহুল সংস্কৃত্যায়নের মতে, দোহা ও চর্যার রচনাকালকে আরও দু’শত বছর পিছিয়ে দিয়ে ৮ম-১২শ শতকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। রাহুলজী তাঁর ‘পুরাতাত্ত্বিক নিবন্ধাবলী’ গ্রন্থে ‘Journal Asiatique’ নামক পত্রিকায় দেখাতে চেয়েছেন লুইপাদ ও সহরপাদ দুজন সিদ্ধাচার্য যারা চর্যা পদকার, তাঁরা ছিলেন ধর্মপালের সমসাময়িক (৭৬৯-৮০৯ খ্রিঃ) এবং ড. শহীদুল্লাহ ‘সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার’ আলোচনায় ভুসুকু ও কাহ্নপাদকে ৮ম শতাব্দীর অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। পণ্ডিত বর্গের এই সমস্ত অভিমতের উপর নির্ভর করে চর্যাপদের রচনাকালকে মূলত ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে স্থাপন করা যেতে পারে।

চর্যাপদের গুরুত্ব :


প্রাচীন বাঙলা ভাষা-বিষয়ে আলােচনার যােগ্য উপাদান বলতে একমাত্র এই চর্যাপদএই যুগে বাঙলা ভাষায় রচিত অপর কোন গ্রন্থের সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। প্রাচীন তথা মধ্যযুগের বহু গ্রন্থের ভাষাই বহু প্রচলিত বলে অনেকটা পরিবর্তিত হলেও আমাদের ভাগ্যক্রমে লােকলােচনের অন্তরালে থাকায় চর্যার ভাষার প্রাচীনত্বটুকু বজায় রয়েছে। ফলে ভাষাবিজ্ঞানীদের নিকট এর মূল্য অসাধারণ। সচেতন সাহিত্যরূপে রচিত না হলেও চর্যাপদে যে মাঝে মধ্যে স্বভাবকবিত্বের স্ফুরণ দেখা যায়, তা অস্বীকার করা যায় না। আবার সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনে দিক-নির্দেশক-রূপে চর্যাপদের স্থান একক; বাঙলার ধর্মবিবর্তনের ইতিহাসেও চর্যার মূল্য অসাধারণ। বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম—উভয়েরই অবক্ষয়িত রূপের একটা সুন্দর চিত্র পাওয়া যায় চর্যাপদে। সর্বোপরি সমকালীন সমাজজীবনের এমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা- জাত চিত্র তাে অন্যত্র দুর্লভ। এই সমস্ত কারণে, যথার্থ সাহিত্যের বিচারে চর্যাপদ উচ্চমানের না হলেও ভাষাবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং ধর্মৰ্গবেষকদের নিকট চর্যাপদ অপরিহার্য সম্পদ বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে।

চর্যাপদের নাম :


বৌদ্ধগানগুলিকে সাধারণভাবে ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাগীতি’ নামে অভিহিত করা হয়। শাস্ত্রী মহাশয় গ্রন্থটির প্রকৃত নাম অনুমান করেছিলেন ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ যার অর্থ—আচরণীয় এবং অনাচরণীয় বিষয় নির্দেশ। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেন যে এর নাম হওয়া উচিত ছিল- ‘চর্যাশ্চর্য-বিনিশ্চয়’। গ্রন্থের মধ্যে মুনিদত্ত-কর্তৃক টীকায় এটিকে আশ্চর্য চর্যাচয় নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বিচারে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে মূল গ্রন্থটির নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ’ এবং ‘চর্যাপদগুলি চর্যাগীতি’ নামে পরিচিত ছিল।

চর্যাপদের গ্রন্থ পরিচয়


চর্যাগীতিকোষ’ গ্রন্থটি পাওয়া গেছে খণ্ডিত আকারে। এতে সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ এবং তেইশ জন কবির নাম পাওয়া গেছে। এর যে তিব্বতী অনুবাদ পাওয়া গেছে, তাতে আরও সাড়ে তিনটি পদ ও একজন কবির নাম পাওয়া যায়। অতএব সমগ্র চর্যাগীতিকোষে ৫০টি বা ৫১টি পদ ও ২৪ জন কবির ভণিতা ছিল। বিভিন্ন সুত্রে অনুমান করা হয় যে, মােট ১০০টি গীতি দুটি বিভিন্ন কোষে সঙ্কলন করা হায়েছিল। কিছুদিন পূর্বে ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল ও তরাই অঞ্চল থেকে আরাে ৯৮টি চর্যাগীত (চাচাগীত’) সঙ্কলন করেন, এদের মধ্যে অন্ততঃ ১৯টি গীত চর্যাগীতির সমকালীন বলে অনুমিত হয়।

চর্যাপদের কবি-পরিচয়:


চর্যাগীতি-রচয়িতাগণ ছিলেন সহজিয়া-পন্থী বৌদ্ধ-সাধারণতঃ ‘সিদ্ধাচার্য’ নামে এদের অভিহিত করা হয়। তিব্বতী গ্রন্থসূত্রে যে চৌরাশি সিদ্ধা’ র নাম পাওয়া যায়, চর্যাপদের ২৪ জন কবি তাদেরই অন্তর্গত। এই ২৪ জন কবির মধ্যে রয়েছে লুইপা, কুক্করীপা, চাটিলপা, ভূসুকুপা, কাহ্নপা, কামলিপা, ডােম্বীপা, শান্তিপা, বীণাপা, সরহপা, ঢেণ্যণপা, তাড়কপা, তন্ত্রীপা ইত্যাদি। চর্যাগীতিকার মধ্যে যে সকল সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায় তাদের অন্যতম কৃষ্ণপাদাচার্য বা কাহ্নপা এর রচিত পদের সংখ্যা ৯। ভুসুকপা ছিলেন চিত্রধর্মী কবি, এঁর রচিত পদের সংখ্যা ১২। সরহপা ও কু্করীপা প্রত্যেকে ৪টি করে পদ রচনা করেছেন। কাহ্নপা এবং সরহপা অবহটঠ ভাষায় কতকগুলি দোহাও রচনা করেছিলেন। অনেকে মনে করেন নাথগুরু মীননাথ লুইপা (রােহিত পাদাচাৰ্য) নামে দু’টি পদ রচনা করেন। শান্তিপা এবং শবরীপা-রও দুটি করে পদ পাওয়া যায়। অপর সিদ্ধাচার্যদের প্রত্যেকের একটি করে পদ পাওয়া যায়। এই সিদ্ধাচার্যগণ প্রত্যেকেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি—এঁরা কামরূপ, মিথিলা, উড়িষ্যা এবং গৌড়বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কালের দিক থেকেও এদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকা সম্ভব। চতুর্দশ শতকে রচিত জ্যোতিরীশ্বরের বর্ণরত্নাকর’ গ্রন্থে এদের সকলের নাম পাওয়া যায়—অতএব এই তারিখের পূর্বে এঁরা অবশ্যই বর্তমান ছিলেন। কোন কোন মতে আদি সিদ্ধাচার্য লুইপা সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর লােক। বিভিন্ন কালে এবং বিভিন্ন স্থানে রচিত পদগুলিতে সম্ভবতঃ মূলে কিছু ভাষাগত বৈচিত্র্য ছিল—পরে কোন এক সময়, অবশ্যই শতাব্দীর পূর্বে এদের সংস্কার সাধন করে অভিন্ন ভাষায় রূপায়িত করা হয়—এই অনুমান যথার্থ হওয়াই সম্ভব।

চর্যাপদের কাব্যমূল্য


‘কাব্যং গ্রাহ্য মলঙ্কারাং’ আচার্য বামনের এই উক্তি চর্যাপদে বেশ সহজলভ্য। যেমন –বিরোধ অলঙ্কারের একটি দৃষ্টান্ত : “জো সো চৌর সোহ সাধি” (যে চোর সেই সাধি) আবার সাঙ্গরূপকের উদাহরণ—
“মনতরু পাঞ্চ ইন্দি তসু সাহা।
আসা বহল পতি ফলবাহা।।”
চর্যাপদের ভাষা যেহেতু ‘সন্ধ্যাভাষা’। তাই এর ভাব ও উদ্দেশ্য প্রতীকের মাধ্যমে বেশ সুন্দরভাবে সুপরিস্ফুট। যেমন—কাহ্নপাদ একটি পদে দাবা খেলার রূপকে বলেছেন—
“করুণা পিহাড়ী খেলঠুন অবল।
সদগুরু বোঁহে জিতেন ভববল।।”
কাব্য রসের দিক থেকে চর্যাপদ হল আদিরসের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। যেমন—“রাতি উইলে কামরু জাতন” প্রভৃতি পংক্তি বিশেষ স্মরণযোগ্য। আবার প্রেম কামনার চিত্ররূপে পাই— “তো মুহু চুম্বি কমল, রস পীবমি।” ইত্যাদি।

প্রাচীনতম এই বাংলা কাব্যে অর্থাৎ চর্যাপদে ছন্দ বৈচিত্র্যও পরিলক্ষিত হয়। যেমন— অড়িল্লা, পজঝড়ি, ত্রিপদী উল্লালা, পাদাকুলক ইত্যাদি। পজঝড়ি ছন্দের একটি দৃষ্টান্ত হল—
“আলি কালি ঘণ্টা নেউর চরণে।
রবি শশী কুন্ডল কিউ আভরণে।।
এ সমস্ত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের গুরুত্ব অপরিসীম।

চর্যাপদের বিষয়


চর্যাগীতিকোষে যে চর্যাগীতিসমূহ সঙ্কলিত হয়েছে, তা প্রধানতঃ আধ্যাত্মিকতা নির্ভর। গীতিকার সিদ্ধাচার্যগণ তাদের বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনভজন-সম্পর্কিত ব্যাপারসমূহ নিজেদের গােষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইতেন বলে এগুলিকে সংকেতে তথা ইঙ্গিতবহ রূপকাদির সাহায্যে পদগুলিতে প্রকাশ করেছেন। সাধারণভাবে পদগুলির যে অর্থ পাওয়া যায়, তাতে সমাজ-সংসারের বিচিত্র পরিচয় পাওয়া গেলেও তা গীতিকারের আসল উদ্দিষ্ট নয়। এর অন্তর্নিহিত যে অর্থযা গুরুমুখ থেকেই শুধু পাওয়া যেতে পারে, সাধন-ভজন-সম্পর্কিত সেই সমস্ত তত্ত্ব এবং তথ্যই পদগুলির প্রকৃত বিষয়বস্তু।

চর্যাপদের ভাষা


চর্যাপদের ভাষা-বিষয়ে বিস্তর মতদ্বৈধ বর্তমান থাকলেও ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করেছেন যে, চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাঙলা। অবশ্য ঐ সময় ওড়িয়া ভাষা এবং অসমীয়া ভাষা বাঙলা ভাষার সঙ্গে অভিন্নভাবে যুক্ত থাকায় এদের দাবিও নস্যাৎ করা যায় না। চর্যার ভাষাকে বলা হয় ‘সন্ধ্যা ভাষা’ বা ‘আলাে-আঁধারি ভাষা’ অথবা সন্ধা ভাষা’ বা সম্যক অনুধাবন করে উপলব্ধি করবার ভাষা। ড. পবিত্র সরকার যার অর্থ করেছেন অভিসন্ধিমূলক ভাষা, অর্থাৎ গৃঢ় সাধন-পদ্ধতি প্রকাশক সংকেতমূলক গূঢ় ভাষা। আসলে এই নাম দুটি ভাষার পরিচয় নয়, বিষয়বস্তুরই পরিচয় বহন করে। বজ্রযানপন্থী বৌদ্ধগণ কালে সহজিয়া-পন্থী হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের সাধন পদ্ধতিকে অতিশয় গুহ্য বিষয়রূপে গ্রহণ করে এমনভাবে সংকেতে তাকে প্রকাশ করে যে, অপর সাধারণের পক্ষে এর মর্মগ্রহণ সম্ভবপর নয়। এদের শেষ কথা ‘গুরু পুচ্ছিআ জান’ অর্থাৎ গুরুকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। এই কারণেই চর্যার ভাষাকে সন্ধ্যা ভাষা’ বা সন্ধা ভাষা’ বলে অভিহিত করা হয়।
চর্যাপদের দর্শন:
সহজিয়াগণ তাদের সাধনতত্ত্বকে বিভিন্ন রূপকের সাহায্যে প্রকাশ করেছেন। হয়তাে হিন্দুদের বিষয়ে তাদের প্রতিকূল মনােভাবের জন্যই তারা এই গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিল। চর্যার টীকাকার মুনিদত্ত চর্যাপদের দার্শনিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে একে ‘শূন্যবাদ’ নামে অভিহিত করেছেন। “শূন্যতাই একমাত্র সত্য—শূন্যতার মধ্যেই সুখদুঃখাদির লােপ ঘটে এবং ইহাতেই মহাসুখের অস্তিত্ব নিহিত। ইহাই অদ্বয় ও সহজ অবস্থা। একমাত্র গুরুর উপদেশেই মহাসুখময় নির্বাণ লাভ করা যাইতে পারে, ইহার জন্য যােগসাধনাদির প্রয়ােজন নাই। মােটামুটি ইহাই চর্যাপদের দার্শনিক তত্ত্ব।”

চর্যাপদের সাহিত্যগুণ


বাঙলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন-রূপে চর্যাপদকে গ্রহণ করা হলেও একে খাঁটি সাহিত্যরূপে গ্রহণ করা যায় না, কারণ বৌদ্ধ সহজিয়াগণ চর্যাপদগুলিকে তাঁদের সাধনতত্ত্বের বাহনরূপেই সৃষ্টি করেছিলেন। এই রচনার পিছনে কোন সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াস বর্তমান ছিল না। তৎসত্ত্বেও চর্যাপদগুলিকে একান্তভাবে ধর্মীয় রচনা বলেও অভিহিত করা যায় না। কারণ এদের কোন কোনটির মধ্যে বাঙ-নির্মিতির শিল্পকৌশল এবং স্বতঃস্ফূর্ত রসের আবেদন এমন স্বাভাবিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে যে এদের সহজ কবিত্বকে অস্বীকার করা সম্ভবপর নয়। প্রকৃত কাব্যসাহিত্যে রসের আবেদনকেই মুখ্য বিষয় বলে গ্রহণ করা হলেও এর ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার, বক্রোক্তি, ধ্বনি

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading