জরিপ গবেষণার উদ্দেশ্য–
জরিপ গবেষণা (Survey Research) হচ্ছে একটি জনপ্রৃতি গবেষণার পদ্ধতি, যা বৃহৎ জনগণের মধ্যে নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রশ্নাবলী, সাক্ষাৎকার, বা অন্যান্য উপকরণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের একটি পদ্ধতি। জরিপ গবেষণার মূল উদ্দেশ্য সাধারণত বৈজ্ঞানিক, সামাজিক বা ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের গভীরতা ও বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রদান করা। জরিপ গবেষণা মূলত ব্যাখ্যামূলক, বিবরণী, ও পরিসংখ্যানমূলক উপাত্ত সংগ্রহ করে এবং এই তথ্যের মাধ্যমে জনসমাজ, আচরণ, মনোভাব, ধারণা, মতামত, অভ্যাস, বা প্রবণতাগুলি বিশ্লেষণ করা হয়।
এখানে জরিপ গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১. তথ্য সংগ্রহ:
জরিপ গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য হলো বৈজ্ঞানিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ করা। এই তথ্য বিভিন্ন সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, অথবা ব্যবসায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কিত হতে পারে। জরিপের মাধ্যমে একসাথে অনেকের মতামত এবং অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, যা গবেষণার বিষয়ের বিষয়ে গভীর অবহিত হওয়ার সুযোগ প্রদান করে।
উদাহরণ: একটি জনমত জরিপে জনগণের পছন্দ, মনোভাব, এবং সামাজিক অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
২. প্রবণতা বিশ্লেষণ:
জরিপ গবেষণা বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা এবং আচরণ শনাক্ত করতে সহায়তা করে। এটি সাধারণত পরিসংখ্যান ভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জনগণের সাধারণ প্রবণতা, অভ্যাস, বা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে জনগণের মনোভাব বুঝতে সাহায্য করে।
উদাহরণ: জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার বৃদ্ধির প্রবণতা বা বাজারের কোনো নতুন পণ্যের প্রতি আগ্রহ বিশ্লেষণ করতে জরিপ করা হতে পারে।
৩. নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বা ধারণা অর্জন:
জরিপ গবেষণার মাধ্যমে অনেক সময় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বা ধারণা অর্জন করা যায়। এটি এমন তথ্য প্রদান করে, যা পূর্বে অজানা ছিল বা যা আগে পর্যাপ্তভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। জরিপের মাধ্যমে দেখা যায় কীভাবে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী বা জনগণের অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হচ্ছে।
উদাহরণ: কোনো নতুন সামাজিক আন্দোলন বা রাজনৈতিক চিন্তা বা ধারণা নতুন প্রজন্মের মধ্যে কীভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে তা জরিপের মাধ্যমে জানা সম্ভব।
৪. সমস্যার নির্ধারণ ও বিশ্লেষণ:
জরিপ গবেষণার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা যায়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ, কারণ কোনো সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের প্রাথমিক অবস্থা বা কারণ নির্ধারণ করা জরুরি। জরিপের ফলাফল যে কোনো প্রেক্ষাপটে সমস্যা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে, যাতে পরবর্তী পদক্ষেপগুলি নির্ধারণ করা যায়।
উদাহরণ: একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের পড়াশোনার মনোভাব ও পরিস্থিতি সম্বন্ধে জরিপ করলে, শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্যা চিহ্নিত করা যাবে যেমন পাঠ্যক্রমের অসুবিধা বা শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে সম্পর্কের সমস্যা।
৫. মডেল বা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা:
জরিপ গবেষণা একটি নতুন তত্ত্ব বা মডেল গঠনের কাজেও সাহায্য করতে পারে। এটি বিভিন্ন সমাজ বা জনগণের আচরণের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা বা ভবিষ্যদ্বাণী তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে। গোষ্ঠীভিত্তিক আচরণ, মনোভাব বা প্রবণতাগুলি যদি নির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করা যায়, তবে এটি নতুন ধারণা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
উদাহরণ: জরিপের মাধ্যমে এটা বোঝা যেতে পারে যে, মানুষের খরচের প্রবণতা কীভাবে সাধারণভাবে কোনো সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে প্রভাবিত হয়।
৬. চাহিদা বা প্রবণতার পূর্বাভাস:
জরিপ গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রবণতার পূর্বাভাস করা সম্ভব হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে জনগণের মতামত বা চাহিদার উপর ভিত্তি করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন পণ্য বা পরিষেবা তৈরি করা যেতে পারে। এভাবে, এটি বাজার গবেষণায় সহায়তা করতে পারে।
উদাহরণ: কোনো পণ্যের জন্য বাজারে চাহিদার পরিমাণ পরিমাপ করার জন্য জরিপের মাধ্যমে এটি বোঝা যায় যে, ওই পণ্যটি বাজারে প্রচলিত হওয়ার পর কীভাবে বিক্রি হতে পারে।
৭. পারফরম্যান্স মূল্যায়ন:
কোনো প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে জরিপ গবেষণা ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে কোনো উদ্যোগের বা কর্মসূচির সফলতা, সমস্যা, এবং উন্নতির ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া, এটি কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
উদাহরণ: একটি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রকল্পের সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ধারণ করতে, প্রকল্পের সুফল বা সমস্যা চিহ্নিত করতে জরিপ করা যায়।
৮. নতুন ডেটা বা সাক্ষ্য পাওয়া:
জরিপ গবেষণা একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বা বিষয় সম্পর্কিত নতুন তথ্য, সাক্ষ্য বা ডেটা উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। এটি প্রচলিত ধারণা বা তত্ত্বগুলির বিরুদ্ধেও নতুন তথ্য প্রমাণ করতে সাহায্য করে। নতুন তথ্যের মাধ্যমে গবেষকরা তাঁদের থিসিস বা উপসংহার পুনর্বিবেচনা করতে পারেন।
উদাহরণ: কোনো সামাজিক নীতি বা শিক্ষানীতির প্রভাব বিষয়ে নতুন তথ্য বের করতে জরিপ করা যেতে পারে।
৯. সামাজিক বা সাংস্কৃতিক প্রভাব বিশ্লেষণ:
জরিপ গবেষণা কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আচরণের বিশ্লেষণ করতে পারে। এটি বিভিন্ন জনগণের মধ্যে সামাজিক আচরণ এবং সংস্কৃতির উপর বিশদ গবেষণা করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মীয় বা আঞ্চলিক পার্থক্য অনুধাবন করাও জরিপের মাধ্যমে সম্ভব।
উদাহরণ: একটি সমাজে জনগণের ধর্মীয় আচরণ বা সাংস্কৃতিক পদ্ধতিগুলি কীভাবে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা প্রভাবিত করছে তা বিশ্লেষণ করার জন্য জরিপ ব্যবহৃত হতে পারে।
১০. সাংস্কৃতিক সমীকরণের জন্য তথ্য প্রস্তুত করা:
জরিপ গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বা পার্থক্য পরিমাপ করা সম্ভব। জরিপের ফলাফল বৈশ্বিক বা স্থানীয় সাংস্কৃতিক সমীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করতে সহায়তা করে।
উদাহরণ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সাংস্কৃতিক পার্থক্য পরিমাপ করার জন্য জরিপ ব্যবহার করা যেতে পারে।
উপসংহার:
জরিপ গবেষণার উদ্দেশ্যগুলি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং গুরুত্বপূর্ণ। এটি তথ্য সংগ্রহ, প্রবণতা বিশ্লেষণ, নতুন ধারণা অর্জন, সমস্যা চিহ্নিত করা, ভবিষ্যদ্বাণী তৈরি এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। জরিপের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিদের বা সংস্থাগুলির জন্য প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে এবং তাদের উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করে।