অ্যারিস্টটলের মতে, ট্র্যাজেডির নায়ক সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা ও অসাধারণ গুণাবলীসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ Poetics-এ ট্র্যাজেডি ও ট্র্যাজিক নায়কের বৈশিষ্ট্যগুলি বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। অ্যারিস্টটল মনে করতেন, ট্র্যাজেডির নায়ককে অবশ্যই এমন একজন ব্যক্তি হতে হবে যিনি সাধারণ মানুষের চেয়ে উচ্চতর এবং মহৎ, কিন্তু সম্পূর্ণ নিখুঁত নন। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মাধ্যমে তিনি ট্র্যাজেডির মূল লক্ষ্য—কথিত ক্যাথারসিস (বিরাগ ও ভয়ের মাধ্যমে মানসিক শুদ্ধি)—প্রাপ্ত হতে সক্ষম হন। ট্র্যাজিক নায়ক সাধারণ মাপের মানুষ নয়, তার কারণগুলিই এখন বিশ্লেষণ করব।
১. মহত্ত্ব এবং অভিজাত্যের প্রয়োজনীয়তা
অ্যারিস্টটল বলেছেন, ট্র্যাজেডির নায়ককে অবশ্যই এমন একজন হতে হবে যিনি সমাজের দৃষ্টিতে বিশিষ্ট ও উচ্চতর। এটি নায়কের ব্যক্তিত্বের মহত্ত্বকে তুলে ধরে। তাঁর ব্যক্তিগত এবং সামাজিক অবস্থান ট্র্যাজেডির নাটকীয়তা এবং আবেগকে বাড়িয়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি ট্র্যাজেডিতে নায়ক একজন রাজা বা রাজপুত্র হন, তবে তার পতন শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত জীবনের নয়, বরং একটি সামগ্রিক সমাজ বা রাজ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। শেক্সপিয়ারের Hamlet নাটকের রাজকুমার হ্যামলেট, যিনি ডেনমার্কের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী, তার চরিত্রের পতন পুরো রাজ্যের পতনের সাথে সম্পর্কিত।
২. হ্যামার্টিয়া (Tragic Flaw)
অ্যারিস্টটল ট্র্যাজিক নায়কের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ‘হ্যামার্টিয়া’ (Hamartia) বা ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। ট্র্যাজিক নায়ক উচ্চতর গুণাবলীসম্পন্ন হলেও তিনি নিখুঁত নন। তার কিছু মানবীয় ত্রুটি বা দুর্বলতা থাকে, যা তাকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়। এই ত্রুটির কারণে দর্শক বা পাঠকের মনে বিরাগ এবং ভয় জাগে। উদাহরণস্বরূপ, শেক্সপিয়ারের Othello নাটকে ওথেলো একজন বীর সেনাপতি, কিন্তু তার হ্যামার্টিয়া হলো তার ঈর্ষা। এই ঈর্ষা তার পতন ও ট্র্যাজেডির কারণ হয়।
এই মানবীয় ত্রুটির মাধ্যমে ট্র্যাজেডির নায়ককে মানবীয় এবং বাস্তবিক মনে হয়। দর্শকরা তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে, কারণ তারা দেখতে পায় যে তার মহত্ত্ব সত্ত্বেও তার ত্রুটি তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এভাবে ক্যাথারসিস ঘটে, কারণ দর্শক বিরাগ এবং ভয়ের মাধ্যমে মানসিকভাবে শুদ্ধ হয়।
৩. ট্র্যাজিক পতনের গভীরতা
অ্যারিস্টটল মনে করেন, ট্র্যাজেডির নায়ক সাধারণ মানুষ হলে তার পতন খুব বেশি নাটকীয় বা আবেগপূর্ণ হবে না। মহৎ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির পতন বেশি মর্মান্তিক এবং তা দর্শকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। যেমন সোফোক্লেসের Oedipus Rex নাটকে, রাজা ইডিপাসের পতন শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত জীবনকেই ধ্বংস করেনি, বরং পুরো থেবস নগরীর জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছিল। যদি ইডিপাস সাধারণ কোনো ব্যক্তি হত, তবে তার পতনের গভীরতা এবং পরিণতি এত বিস্তৃত এবং আবেগপ্রবণ হতো না।
৪. সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব
ট্র্যাজিক নায়কের মহত্ত্ব শুধু তার ব্যক্তিগত গুণাবলীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তার সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকার সঙ্গেও যুক্ত থাকে। অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে, ট্র্যাজেডির নায়ক সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়া উচিত, কারণ তার পতন কেবল তার নিজের জীবনে নয়, সমাজেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এভাবে, ট্র্যাজেডি কেবল একটি ব্যক্তিগত কাহিনি নয়, এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক নাটকও হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, শেক্সপিয়ারের Macbeth নাটকের ম্যাকবেথ একজন ক্ষমতাসীন রাজা, যার পতন শুধু তার নিজের ধ্বংস নয়, বরং পুরো রাজ্যের জন্যও ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনে।
৫. ক্যাথারসিসের গুরুত্ব
অ্যারিস্টটলের মতে, ট্র্যাজেডির মূল লক্ষ্য হলো ক্যাথারসিস বা মানসিক শুদ্ধি। ট্র্যাজিক নায়কের উচ্চতর স্থান ও মহত্ত্ব দর্শকদের মধ্যে বিরাগ ও ভয়ের জন্ম দেয়, যা ক্যাথারসিসের জন্য প্রয়োজনীয়। একজন সাধারণ মানুষের পতন দর্শকদের মধ্যে এই ধরনের আবেগ সৃষ্টি করতে পারত না। তাই ট্র্যাজিক নায়কের মহত্ত্ব এবং বিশেষত্ব ক্যাথারসিসের জন্য অপরিহার্য।
উপসংহার
অ্যারিস্টটলের মতে, ট্র্যাজেডির নায়ক সাধারণ মাপের মানুষ নয়, বরং একজন মহৎ এবং অসাধারণ গুণাবলীসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে ট্র্যাজেডির নাটকীয়তা এবং আবেগের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। তার মানবীয় ত্রুটি তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, যা কাহিনির চরম বিন্দুতে দর্শকদের মনকে স্পর্শ করে। ট্র্যাজিক নায়কের এই মহত্ত্ব, ত্রুটি, এবং পতনই ট্র্যাজেডির সার্থকতা এবং অ্যারিস্টটলের ধারণা অনুযায়ী ক্যাথারসিসের মাধ্যমে মানসিক শুদ্ধির মূল মাধ্যম। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, অ্যারিস্টটলের অভিমত যথার্থ এবং তাঁর এই ধারণা সাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।