পাহাড়পুর ভাস্কর্য :
বঙ্গদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্র হল পাহাড়পুর। পাহাড়পুর থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছু পোড়ামাটির সিলের ভিত্তিতে জানা যায় যে, পুলে রাজা ধর্মপাল এই অঞ্চলে সোমপুরা মহাবিহার নির্মাণ করেছিলেন।
“শ্রী সোমপুরে শ্রী ধর্মপালদেবা মহাবিহারিয়ার্য্য-ভিক্ষু সঙ্ঘস্য”।
-এই প্রাপ্ত লেখ থেকে জানা যায়, পাল রাজা ধর্মপাল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বসবাসের জন্য আনুমানিক অষ্টম শতকে সোমপুরা মহাবিহার নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহি জেলায় এই প্রত্নক্ষেত্রটির অবস্থান।
Buchanan Hamilton 1807-1812 সালের ক্ষেত্রসমীক্ষায় সর্বপ্রথম পাহাড়পুর প্রত্নক্ষেত্রের উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে Westmacott এই ক্ষেত্রটি পরিদর্শন করেন। আরও পরবর্তীকালে Sir Alexander Cunningham 1879 সালে প্রত্নক্ষেত্রটি পরিদর্শন করেন।সোমপুরা মহাবিহারের কেন্দ্রস্থলে একটি বৃহদাকার ঐশাকৃতি মন্দিরের (356’6″ North-South/314′ 3″ East-West) অবস্থান, মূল মন্দিরের চারদিক পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে 177টি কক্ষবিশিষ্ট মঠের দ্বারা। পাহাড়পুরের মূল মন্দির থেকে মোট 63টি ভাস্কর্য (Sculpture)-এর নিদর্শন পাওয়া যায়। নির্মাণের উপাদানের ওপর ভিত্তি করে প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলিকে ১টি পৃথক শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে-
Group 1-Grey Sandstone, Group II-Bluish Basalt, Group III-Black Basalt
KN Dikshit, SK Saraswati প্রমুখ পন্ডিতদের মতে, একটি Group-এব ভাস্কর্যতে গুপ্ত শৈলী প্রতিফলিত হয়েছে; আবার K N Dikshit অপর একটি শ্রেণির ভাস্কর্যগুলিতে বাংলার নিজস্ব ভাস্কর্য নির্মাণশৈলীর সূচনা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। ভাস্কর্য নির্মাণের সময়কালকেও দুটি ভাগে ভাগ করেছেন এই দুই পণ্ডিত। SK Saraswati পাহাড়পুর থেকে প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলিকে-Late Gupta Period, Post Gupta Period এবং Prepala to early Pala Period এই ও ভাগে ভাগ করেছেন।
প্রথম শ্রেণির ভাস্কর্য নমুনাগুলির অন্যতম হল একটি প্রেমময় দম্পতি। K N Dikshit এই দম্পতিকে কৃল্প এবং রাধা বলে উল্লেখ করেছেন। তবে অনেক ঐতিহাসিক এই মত গ্রহণ করেন না। প্রথম শ্রেণির অন্যান্য ভাস্কর্যগুলির মধ্যে যমুনা, বলরাম এবং শিব বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে মোট ভাস্কর্যের সংখ্যা 15। এই শ্রেণির ভাস্কর্যগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃত্বের বাল্যকালের বিভিন্ন ঘটনা চিত্রিত করেছে। এগুলির মধ্যে কৃত্বের দ্বারা দুটি অর্জুন বৃক্ষের উৎপাটন, চানুরা ও মুষ্টিকের সহিত কৃষ্ণ ও বলরামের কুস্তি, কৃত্বের দ্বারা দৈত্যবধ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও ইন্দ্র, অগ্নি, যম এবং শিবের বিভিন্ন মূর্তিও উল্লেখযোগ্য।
তৃতীয় শ্রেণির মূর্তিসংখ্যা অন্য দুই শ্রেণির তুলনায় বেশি এবং ক্ষয়প্রাপ্ত। তৃতীয় শ্রেণির ও বেশিরভাগ ভাস্কর্য কৃয়ের জীবনের নানা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃত্ব। এগুলির মধ্যে, দেবকী কর্তৃক সদ্যোজাত কৃষ্ণকে বাসুদেবের হাতে অর্পণ, সদ্যোজাত কুরুকে নিয়ে বাসুদেবের কংসের কারাগার থেকে গমন, বালক কৃত্বের মাখন চুরি, কৃষু ও বলরামের সঙ্গে অন্যান্য গোপালক বালকদের খেলা, কৃত্বের দ্বারা প্রলম্ব হত্যা, কুরু ও অর্জুনের সংঘর্ষ, রাবণ ও জটায়ুর সংঘর্ষ ইত্যাদি ভাস্কর্যগুলি উল্লেখযোগ্য।
পাহাড়পুরের ভাস্কর্যগুলির মধ্যে প্রাপ্ত একটি অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি-র মূর্তি একটিমাত্র বৌদ্ধ ভাস্কর্যের নিদর্শন।ছাড়াও দ্বারপাল-এর ভাস্কর্য, প্রণয়ী দম্পতি, অপরূপ ভঙ্গিমায় নৃত্যরত নারী প্রভৃতি ভাস্কর্য পাহাড়পুর থেকে পাওয়া যায়। Stella Kramrisch-এর মতে, পাহাড়পুরের প্রতিটি ভাস্কর্য একই সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক (7 century CE)-এ নির্মিত হয়েছে। আবার Frederick Asher ভাস্কর্যগুলির নির্মাণকাল নির্ধারণ করেছেন খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক (8 century CE)-এ। পাহাড়পুর থেকে প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলির সময়কাল এবং নির্মাণশৈলী বিষয়ে ঐতিহাসিক মহলে বিতর্ক থাকলেও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে পরবর্তী গুপ্ত যুগ এবং পূর্ব পাল যুগের মধ্যবর্তী উত্তরণকালে ভাস্কর্যগুলি নির্মিত হয়েছিল এবং উত্তরবঙ্গের শিল্পকলার এক অন্যান্য নিদর্শন রূপে আজও বিখ্যাত।