প্রাচীন বাংলার সামাজিক-ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান :
বর্তমান উত্তরবঙ্গ প্রাচীন যুগে পুণ্ড্রবর্ধন নামে পরিচিত ছিল। ঐতিহাসিক নানা কারণে একসময় উত্তরবঙ্গ প্রাচীন জনপদরূপে চিহ্নিত হয়েছিল। কিন্তু গৌড় সাম্রাজ্যের পতনের পর এই অঞ্চল বৃহত্তর বঙ্গ ও ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। প্রাচীন উত্তরবঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল রাজবংশী ক্ষত্রিয়রা। দেশি-পলি ও কোচদেরও এই জনগোষ্ঠীর অংশ বলা হয়ে থাকে। প্রাচীন উত্তর বাংলার ধর্মকর্মগত জীবনের সুস্পষ্ট একটি চিত্র রচনা দুরূহ। স্বভাবতই ধর্মকর্মগত মানস-জীবন ব্যাবহারিক জীবন অপেক্ষা অনেক বেশি জটিল। প্রাচীনকাল থেকেই উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু, ইসলাম ধর্মের প্রভাব পড়ে। বস্তুত, উত্তর বাংলার ধর্মকর্মের গোড়াকার ইতিহাস হচ্ছে রাঢ়-পুণ্ড্র-কর্ণ প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদগুলির অসংখ্য জন ও কোমের পূজা, আচরণ, অনুষ্ঠান, ভয়, বিশ্বাস, সংস্কার প্রভৃতির ইতিহাস। এ তথ্য সর্বজনস্বীকৃত যে, আর্য ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ জৈন ইত্যাদি সম্প্রদায়ের ধর্মকর্ম, শ্রাদ্ধ, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু প্রভৃতি সংক্রান্ত বিশ্বাস, সংস্কার ও আচার-অনুষ্ঠান নানা দেবদেবীর রূপ ও কল্পনা অনেক কিছুই আমরা সেই আদিবাসীর নিকট থেকেই আত্মসাৎ করেছি।
উত্তরবঙ্গোর আদিবাসীরা অন্যান্য দেশের অনেক আদিবাসীর মতো বিশেষ বৃক্ষ, পাঘর, পাহাড়, ফল, ফুল, পশু, পক্ষী বিশেষ বিশেষ স্থান ইত্যাদির ওপর দেবত্ত্ব আরোপ করে পূজা করত। এখনও খাসিয়া, মুন্ডা, সাঁওতাল, রাজবংশী, বুনো শবর ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোকেরা তা করে থাকে। তখনকার মতো গাছ পুজো এখনও বহুল প্রচলিত, বিশেষভাবে তুলসী গাছ, সেওড়া গাছ ও বটগাছ। আমাদের পূজার অনুষ্ঠানে দেবীঘটে দেওয়ার জন্য
যে আম্রপল্লব প্রয়োজন হয়, কলা-বৌ পুজো হয় বা ধানের ছড়ার প্রয়োজন হয়, তা সমস্তই সে আদিবাসীদের ধর্মকর্মানুষ্ঠানের এবং বিশ্বাস ও ধারণার স্মৃতি বহন করে। আমাদের নানান আচার-অনুষ্ঠানে বা ধর্ম-সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান, ধানের গুচ্ছ, ধান-দূর্বার আশীর্বাদ, কলা, হলুদ, সুপারি, কলাগাছ, ঘট, গোবর, কড়ি যা কিছু শিল্প বর্তমান তার অনেকখানি এই আদিবাসীদের সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে। জড়িত। পূজাচর্নার মধ্যে ঘট-লক্ষ্মীর পুজো, ষষ্ঠীপূজা, মনসাপূজা, শ্মশান-কালীপূজা, চড়কপূজা, হোলি, পৌষপার্বণ, নবান্ন, রাজবংশীদের মধ্যে নয়া খই ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। উত্তরবঙ্গের পল্লিগ্রামের সমাজের মধ্যে মাঠে হাল চালনার প্রথম দিনে, বীজ ছড়নোর, ধান বোনার, ফসল কাটার বা ঘরে তোলার আগে নানা প্রকারের আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। বিশেষ বিশেষ দিনে কামারের হাপর, কুমোরে চাক, তাঁতীর তাঁত, চাষির লাঙল, ছুতোর, রাজমিস্ত্রির কারুযন্ত্র প্রভৃতিকে আশ্রয় করে এক ধরনের ধর্মকর্মানুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। এরই কিছুটা আর্যীকৃত সংস্কৃতি রূপ আমরা বিশ্বকর্মাপূজার মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। এইসব গ্রাম্য কৃষি ও কারুজীবনের পূজাচারকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গোর ধর্মকর্মময় জীবনের অনেক সৃষ্টির আনন্দ ও উদ্যোগ, শিল্পময় জীবনের অনেক মাধুর্য ও সৌন্দর্য, এইসব আচার-অনুষ্ঠানের অনেক আবহ ও উপাচার আমাদের ভদ্রস্তরে আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্মকর্মের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে অনুসৃত হয়ে গিয়েছে।
বৈয়ব ধর্মও সমগ্র উত্তরবঙ্গকে প্রভাবিত করেছিল। বিভিন্ন আদিবাসী জাতি-উপজাতি তাদের লোকাচার ও লোকধর্মের সঙ্গে নানা ধর্মের দেবদেবীর আরাধনা করেছে এবং বহু লোকায়ত দেবদেবীরও উদ্ভব ঘটেছে। সমগ্র উত্তরবঙ্গে শিব সাধনার সঙ্গে সঙ্গে বৈয়বধর্মের প্রতিপালন উত্তরবঙ্গের লোকজীবনকে যেভাবে আপ্লুত রেখেছিল তার প্রকাশ এখনকার লোকসংস্কৃতি, লোকধর্ম ও নানা লোকাচারের মধ্যে দেখা যায়। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় শিব হয়েছেন কৃষির দেবতা। আবার সুজলা সুফলা করবার জন্য নদীমাতৃক দেশে নদীকেও দেবতাজ্ঞানে পুজোর প্রচলন হয়।
প্রাচীন উত্তর বাংলার পল্লিসমাজে গ্রাম দেবতার প্রচলন ছিল। সাম্প্রতিক কোথাও তিনি কালী, কোথাও ভৈরব, কোথাও বনদুর্গা, কোথাও অন্য কোনো স্থানীয় নামে পরিচিত। আদিবাসীদের এইসব গ্রাম্য দেবতার প্রতি আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি খুব শ্রন্থিতচিত্ত ছিল না। প্রাচীন ভারতবর্ষে যেমন গরুড়ধ্বজা, মীনধ্বজা, ইন্দ্রধ্বজা, ময়ুরধ্বজা, কপিধ্বজা প্রভৃতি নানা প্রকারের ধ্বজা উৎসব প্রচলিত ছিল প্রাচীন উত্তরবঙ্গও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ধ্বজা বা কেতনপুজোর মতো নানা প্রকারের যাত্রাও প্রাচীন উত্তরবাংলার অন্যতম প্রধান উৎসব বলে গণ্য হত। যাত্রার মধ্যে রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা প্রভৃতি লৌকিক
ধর্মোৎসব পালিত হত। আর্য ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ উচ্চকোটির লোকেরা এই ধরনের যাত্রা :
ওসমাজোৎসব পছন্দ করতেন না। গাছপুজো, নানা প্রকারের যজ্ঞন্দ্রীয় দেবীর পূজা ক্ষেত্রপালের পূজা, প্রাচীন উত্তরবাংলার একটি বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠান ছিল। বিভিন্ন প্রকারের ব্রতে অনুষ্ঠানেরর কথাও আমরা জানতে পারি যা তাদের দৈনন্দীন জীবনের সঙ্গে জড়িত ছিল। ব্রত্তোৎসরের বাইরে সমাজের নিম্নস্তরে অন্তত দুটি ধর্মানুষ্ঠান ছিল যার ব্যাপ্তি ও প্রভাব সুবিস্তৃত এবং যা মূলত অবৈদিক, অপৌরাণিক ও অব্রাক্ষ্মণ্য। একটি ধর্মঠাকুরের পূজা ও আর-একটি চৈত্র মাসে নীল বা চড়ক পূজা। মালদা অঞ্চলে যে গম্ভীরার পূজা বা বাংলার অন্যত্র যে শিবের গাজন হয় তা এই চড়ক পূজারই বিভিন্ন রূপ। শিবের গাজন, ধর্মঠাকুরেরও তেমনই গাজন ছিল এবং এই গাজন উৎসবের দুটি প্রধান অলা একটি ঘরভরা বা গৃহভিরণ, অন্যটি ‘কালিকা পাতা’ বা কালী কাচ নৃত্য অর্থাৎ, নরমুণ্ড হাতে নিয়ে কালী বেশে অর্থাৎ কালির প্রতিবিম্বে নৃত্য। প্রাচীন বাংলাসহ উত্তর বাংলায় মনসা পূজার প্রচলন ছিল এর সঙ্গে জড়িত ছিল বিষোহরি পূজা। মনসা হচ্ছে সর্পদেবী এবং সাপ প্রজনন শক্তির প্রতীক এবং মূলত কৌম সমাজের প্রজনন শক্তির পূজা থেকেই মনসা পূজার উদ্ভব। কালবিবেশ্চ গ্রন্থ ও পরবর্তী কালিকাপুরাণে শারদীয়া দুর্গাপূজার দশমী তিথিতে শারোৎসব নামে এই উৎসবের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।
উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে ধর্ম-কর্ম-অনুষ্ঠানাদি নির্বাহের জন্য এদের নিজস্ব সামাজিক পূজক থাকতেন। এরা বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন, যথা-অধিকারী, দেউসী, ওঝা, কীর্তিনিয়া ইত্যাদি। প্রাচীন উত্তরবঙ্গের প্রায় সব প্রান্তেই কালী বা বিভিন্ন নামে পূজিত হতেন। উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের মধ্যে দেবী দুর্গার প্রধান পরিচয় ছিল দেবীঠাকুর হিসেবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন লৌকিক দেবতার পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন-ভান্ডানী, ভান্ডারনী ও ভাণ্ডালী। অম্বুবাচি পূজা মুখ্যত মা কামাখ্যার পূজা যা উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে তা ‘আমাতি’ বলে পরিচিত ছিল। এই সমাজে আমাতির জন্য তিনদিন নির্দিষ্ট রাখতে হত। চৈত্র সংক্রান্তিকে মহাবিষুব বা বিষুব সংক্রান্তে বলা হয়। রাজবংশী সমাজের মানুষেরা এই দিনটিকে বিন্তুয়া নামে পালিত করত। এগুলি ছাড়াও প্রাচীন উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে প্রচলিত নানা রকমের পূজা-পার্বণের তালিকা দেওয়া হল, যথা-বৈশাখী-আষাঢ়ী সেবা, গ্রাম ঠাকুর, গচিরণা, সত্যপীর, পুষুণা, তুলসীঠাকুরানি, জগন্নাথ ও বলরাম ঠাকুর, জন্মাষ্টমি ও দদিকাদো, হনুমান ঠাকুর, রাখালঠাকুর, পাগেলাপীর ইত্যাদি।