প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘শুধু কেরাণী’ একটি অনবদ্য ছোটগল্প, যেখানে মধ্যবিত্ত কেরাণী জীবনের অসহায়তা, করুণ বাস্তবতা এবং সামাজিক বঞ্চনার মর্মস্পর্শী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এই গল্পে লেখক একদিকে যেমন কেরাণীদের একঘেয়ে ও নিরানন্দ জীবনের চিত্র এঁকেছেন, তেমনি তুলে ধরেছেন তাদের আত্মমর্যাদা, সীমাবদ্ধ প্রতিবাদ, এবং মানবিক অস্তিত্ব রক্ষার নিরন্তর সংগ্রাম। নিচে বিশ্লেষণ করে ধাপে ধাপে গল্পটির মূল ভাব ও কেরাণী জীবনের করুণ স্বরূপ উদঘাটন করা হলো:
১. কেরাণী জীবনের নিস্তরঙ্গ দৈনন্দিনতা
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘কেরাণী’ একজন নামহীন, গড়পড়তা মানুষ, যার পরিচয় শুধু তার পেশা দ্বারা নির্ধারিত। তার কোন নিজস্ব পরিচয় নেই। এই বেনামী কেরাণী আসলে সমাজের সেই বিশাল সংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে, যারা জীবনভর অফিসের খাতা-কলমে ডুবে থেকে ধীরে ধীরে একঘেয়ে যন্ত্রে পরিণত হয়ে যায়।
তার জীবন একটি নিয়মমাফিক চক্রে আবদ্ধ – অফিস যাওয়া, কাজ করা, ফিরে আসা, খাওয়া, ঘুম – যেন জীবনের কোনো রোমাঞ্চ, স্বপ্ন, চাহিদা আর অবশিষ্ট নেই। প্রেমেন্দ্র মিত্র এই নিস্তরঙ্গ জীবনচক্রের মাধ্যমে কেরাণী জীবনের রুক্ষতা ও প্রাণহীনতাকে গভীরভাবে প্রকাশ করেছেন।
২. আত্মপরিচয়ের সংকট ও স্বপ্নহীনতা
কেরাণী জীবনে সবচেয়ে বড় সংকট তার আত্মপরিচয়ের – সে জানেই না, সে কে! তার পরিচয় শুধু তার পেশা। সমাজের চোখে সে শুধু একজন ‘কেরাণী’ – না কোনো ব্যক্তিত্ব, না কোনো স্বাতন্ত্র্য।
এই আত্মপরিচয়ের সংকট তার মধ্যে ধীরে ধীরে এক ধরণের আত্মবিস্মৃতি ও স্বপ্নহীনতার জন্ম দেয়। গল্পে আমরা দেখতে পাই, কেরাণী নিজেই অবাক হয়ে ভাবে – “আমি কী?” – এ যেন অস্তিত্বের প্রশ্ন, কিন্তু তার কোনো উত্তর নেই।
এই আত্মপরিচয়ের হারিয়ে যাওয়া একটি সমাজব্যবস্থার দগদগে ক্ষতকে সামনে আনে – যেখানে মানুষকে শুধু শ্রমিক হিসেবে দেখা হয়, মানুষ হিসেবে নয়।
৩. পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশার বোঝা
কেরাণী জীবনে পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের একটি তীব্র চাপ রয়েছে। সে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কিছু করতে পারে না। পরিবার, সন্তানের ভবিষ্যৎ, স্ত্রীর চাহিদা – এই সমস্ত কিছুর ভার কাঁধে নিয়ে প্রতিদিন সে এগিয়ে চলে নিঃশব্দে।
সে তার নিজের কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে না, অথচ পরিবারের জন্য তার ত্যাগ সীমাহীন। গল্পে লেখক এমনভাবে বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন, যেন এই কেরাণী সমাজের ‘ত্যাগের প্রতীক’ – যিনি নিজের সমস্ত স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে টিকিয়ে রাখেন।
৪. যন্ত্রে পরিণত হওয়া ও ক্লান্তি
গল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো – কেরাণী ধীরে ধীরে যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। প্রতিদিন অফিসে নির্দিষ্ট সময়, নির্দিষ্ট কাজ, নির্দিষ্ট ব্যবহারে তার জীবন চলতে থাকে। তার কোনো সৃজনশীলতা নেই, কোনো অনুভূতির প্রকাশ নেই – যেন একটি টাইপরাইটার বা লেদমেশিন।
এই যান্ত্রিকতার কারণে সে এক প্রকার ক্লান্তিতে ভুগছে – শরীরিক ক্লান্তি নয়, আত্মিক ক্লান্তি। জীবনের অর্থহীনতা তাকে গ্রাস করছে। লেখক অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে এই ক্লান্তি ও শূন্যতার অনুভূতি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
৫. বিদ্রোহের ক্ষীণ স্ফুলিঙ্গ
গল্পের শেষের দিকে দেখা যায়, কেরাণীর মধ্যে একটি ক্ষীণ বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জাগে। সে চায় একদিন অফিসে না যেতে, নিজের মতো করে সময় কাটাতে – কিন্তু বাস্তবে সে তা করতে পারে না।
এই অক্ষম বিদ্রোহ একদিকে যেমন তার জীবনের অতল অসহায়তাকে প্রকাশ করে, তেমনি আরেকদিকে তার অন্তরের বিক্ষোভ ও বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দেয়। সে হয়তো চিৎকার করে বলতে চায় – “আমি শুধু কেরাণী নই, আমি মানুষ”, কিন্তু সেই চিৎকার চাপা পড়ে যায় দায়িত্ব ও শৃঙ্খলার নিচে।
৬. সমাজব্যবস্থার নৈরাশ্যজনক কাঠামো
এই গল্পটি শুধুমাত্র একটি কেরাণীর ব্যক্তিগত দুঃখগাঁথা নয়, বরং সমাজের একটি বড় সমস্যার দৃষ্টান্ত। প্রেমেন্দ্র মিত্র এই গল্পের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, কীভাবে একটি শ্রেণিকে শুধুমাত্র শ্রমিক বা কেরাণীতে পরিণত করে সমাজ তাদের মানবিকতা কেড়ে নিচ্ছে।
এই গল্প সমাজের নৈরাশ্যজনক কাঠামোর বিরুদ্ধে এক ধরণের নীরব প্রতিবাদ। লেখক সুনিপুণভাবে দেখিয়েছেন – কেরাণী আসলে একজন বলি-পাঁঠা, যে তার জীবন দিয়ে এক নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখছে।
উপসংহার
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘শুধু কেরাণী’ একটি গভীর মানবিক বোধে পূর্ণ গল্প, যেখানে কেরাণী জীবনের করুণতা, নিঃসঙ্গতা, যন্ত্রণা এবং আত্মপরিচয়ের সংকট অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই গল্পে কেরাণী কেবল একটি পেশাজীবী চরিত্র নয় – বরং সে এক প্রতীক, যাকে কেন্দ্র করে লেখক সমাজের অবিচার, একঘেয়েমি, নিপীড়ন ও মূল্যহীনতার গভীর চিত্র এঁকেছেন। এইভাবে ‘শুধু কেরাণী’ গল্পটি আমাদের সামনে কেরাণী জীবনের অসহায়তা ও করুণ বাস্তবতাকে উদঘাটন করে তোলে – যেখানে মানুষ আছে, কিন্তু সে নিজের মানুষত্বটুকুই হারিয়ে ফেলেছে।