অথবা, উনিশ শতকের বাংলা নাটকের বিকাশে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান কতখানি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করো।
একাধিক প্রতিভার অধিকারী দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নাটকেও সমান দক্ষ। উনিশ ও বিশ শতকের যুগসন্ধিক্ষণে তাঁকে নাটক রচনায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। বিশ শতকের সূচনাতেই তাঁর অকালপ্রয়াণ বাংলা নাট্যসাহিত্যের সমূহ ক্ষতি করেছে। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রধান কৃতিত্ব ঐতিহাসিক নাটক রচনার দক্ষতায়। উনিশ শতকে ঐতিহাসিক নাটক লেখার যে জোয়ার এসেছিল, যা পরাধীন ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের স্বদেশ-চেতনা বৃদ্ধিতে সহায়তা হয়েছিল, সে তালিকায় অন্যতম নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তবে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলালের মতো তিনি অভিনেতা ছিলেন না। দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যপ্রতিভার কথা স্মরণ করতে গিয়ে নাট্য সমালোচক অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন-“তাঁহার প্রতিভার বিচিত্র শতদল তাঁহার রচনার মধ্য দিয়া ক্রমে ক্রমে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। প্রহসন এবং নাট্যকাব্যের সময় ইহা অস্ফুট কোরকের ন্যায় অপূর্ণ ছিল, ধীরে ধীরে ইহার পাপড়িগুলি প্রসারিত হইয়া ঐতিহাসিক নাটকে পূর্ণ পরিস্ফুট হইয়া চতুর্দিকে সৌরভ ছড়াইতে লাগিল।”
দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকগুলিকে মূলত চারভাগে ভাগ করা যায়-
ক। প্রহসন: ‘একঘরে’ (১৮৮৯), ‘কল্কি অবতার’, ‘বিরহ’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘পুনর্জন্ম’ ও ‘আনন্দ বিদায়’ (১৯১২)।
খ। পৌরাণিক নাটক: ‘পাষাণী’ (১৯০০), ‘সীতা’ (১৯০৮) ও ‘ভীষ্ম’ (১৯১৪)।
গ। ঐতিহাসিক নাটক: ‘তারাবাঈ’ (১৯০৩), ‘প্রতাপসিংহ’ (১৯০৫), ‘দুর্গাদাস’
(১৯০৬), ‘নূরজাহান’ (১৯০৮), ‘মেবার পতন’ (১৯০৮), ‘সাজাহান’ (১৯০৯) ও ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১)।
ঘ। সামাজিক নাটক: ‘পরপারে’ (১৯১২) ও ‘বঙ্গানারী’ (১৯১৫)।
দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ‘তারাবাঈ’। এ নাটকের কাহিনি নাট্যকার রাজস্থানের ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করেছেন। ‘প্রতাপসিংহ’ (১৯০৫) স্বদেশি আন্দোলনের যুগে লেখা। প্রতাপের বীরত্ব, শৌর্য, আত্মত্যাগের মহিমার মাধ্যমে দেশবাসীকে এক মহান শিক্ষা দিয়ে যান। সংগতভাবেই সমালোচক অজিতকুমার ঘোষ এ নাটক সম্পর্কে লিখেছেন-“প্রতাপসিংহ হইতেই মহাব্রতনিষ্ঠ স্বদেশী ভাবরঞ্জিত নাটকীয় যুগের সূচনা হয়।” হিন্দু-মুসলমানের এক মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। আকবর প্রতাপসিংহের বীরত্বকে সম্মান জানিয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ‘নূরজাহান’। অন্তর্দ্বন্দ্বের বিচারে ‘নূরজাহান’ তীব্র ও মনস্তত্ত্বধর্মী। নারীর জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রত্যয়ের যে সন্ধান তিনি গড়ে তুললেন, তা বিংশ শতকের সূচনায় এই নাটককে অন্যতম করে তোলে। এ নাটকের চারণীদের কণ্ঠে যে উদ্দীপিত সংগীত ধ্বনিত হয়েছিল তা বলাভলা প্রাক্কালে বাঙালিকে ঐক্যের মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে গিয়েছিল-
“কিসের শোক করিস ভাই আবার তোরা মানুষ হ’।
গিয়েছে দেশ দুঃখ নাই…আবার তোরা মানুষ হ’।
ঘুচাতে চাস যদি রে এই হতাশাময় বর্তমান।
বিশ্বময় জাগাতে তোল ভায়ের প্রতি ভায়ের টান।” ‘নূরজাহান’ নাটকের পাশেই রয়েছে ‘সাজাহান’ নাটক। এমনকি অন্তর্দ্বন্দ্বে দুটি নাটক সার্থক। দুটি নাটকেই ট্র্যাজেডির বীজ বড়ো হয়ে উঠেছে। আসলে উনিশ শতকের ঐতিহাসিক নাটকে দেশপ্রেমের মহিমা দেখাতে এই ট্র্যাজেডি এসেছে। চারণ বালকদের কণ্ঠে নাট্যকার যখন ফুটিয়ে তোলেন-“ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা” গান, তখন বাঙালি নাট্যমোদী দর্শকও ভেসে যায় এক আবেগের জগতে, বাঙালির চিরন্তন মণিকোঠায় তা স্থায়ী হয়ে থাকে।
উনিশ শতকে এসেছিল পৌরাণিক নাটকের জোয়ার। পুরাণেব মহিমা নবরূপে ফুটিয়ে তোলা যেমন অভিপ্রায় ছিল, তেমনি নাট্যকারদের কাহিনির প্রয়োজনে বারবার পুরাণের জগতে যেতে হত। তবে সবাই পুরাণের কাহিনিকে নতুন করে নির্মাণ করে
নিতেন। দ্বিজেন্দ্রলালও তাই করেছেন। ভীষ্মের আত্মত্যাগকে সামনে রেখে বাঙালি পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। বাঙালির চিরন্তন কুপ্রথা পণ ও বাল্যবিবাহের বিষাদময় দৃশ্য বাঙালির কাছে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলেন ‘বঙ্গানারী’ নাটকে। দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যজীবনের কলঙ্ক ‘আনন্দ বিদায়’ গ্রহসন। এ প্রহসনে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ব্যা করলেন, যা বাঙালি মেনে নিতে পারেনি। বিংশ শতকের সূচনায় একজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু বাংলা নাটকের বিরাট ক্ষতি করেছে। ইউরোপীয় প্রভাবকে সামনে রেখেও তিনি নাটকের ক্ষেত্রে অধুনিকতা এনেছিলেন। সংলাপ, নাট্যবিন্যাস ও রূপকধর্মীতায় তিনি ক্লাসিকতার সাক্ষর রেখে গেছেন। তাই নাট্য সমালোচক অজিতকুমার ঘোষ দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যপ্রতিভার মূল্যায়নে লিখেছেন-“দ্বিজেন্দ্রলালের সর্বাপেক্ষা কৃতিত্ব বোধ হয় এইখানে যে, তাঁহার সৃষ্ট চরিত্রগুলি অন্তর্দ্বন্দ্বে এবং বিরুদ্ধ ভাব সংঘাতে অতিশয় প্রাণময় এবং আবেগময় হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহার পূর্ব পর্যন্ত আমরা বাংলা নাটকে দেখিয়াছি যে চরিত্রগুলি নিতান্ত স্পষ্ট এবং সহজ; হয় তাহারা অবিমিশ্র ভালো অথবা নিরবচ্ছিন্ন মন্দ।”