বাংলা ভাষার যুগবিভাজন

বাংলা ভাষার যুগবিভাজন

আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিবর্তনের প্রায় এক হাজার বছরের ইতিহাসকে মূলত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়-

(১) প্রাচীন বাংলা (Old Bengali)

(২) মধ্য বাংলা (Middle Bengali)

(৩) আধুনিক বাংলা (New Bengali)

(১) প্রাচীন বাংলা (Old Bengali):

আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই স্তরের কালসীমা। এই পর্বের বাংলা ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের রচিত চর্যাগীতিতে, ‘অমরকোষ’-এর সর্বানন্দ রচিত টীকায় প্রদত্ত চারশ’-রও বেশি বাংলা প্রতিশব্দে। এই স্তরের বাংলা ভাষার প্রধান বিশেষত্ব হল দীর্ঘীভবন (ধর্ম ধম্ম ধাম), পদান্তিক স্বরধ্বনির স্থিতি (ভণতি >

ভণই), ‘য়’-শ্রুতি ও ‘ব’-শ্রুতি (নিকটে নিয়ড্ডী); ‘-এর’, ‘-অর’, ‘র’ বিভক্তিযোগে সম্বন্ধপদ (রুখের তেন্তলি); ‘-ক’, ‘-কে’, ‘-রে’ বিভক্তিযোগে গৌণকর্ম ও সম্প্রদানের পদ (ঠাকুরক ঠাকুরকে); ‘-ই’, ‘-এ’, -‘হি’, ‘-তে’ বিভক্তিযোগে অধিকরণ (নিয়ড্ডী নিকটে); ‘এ’ বিভক্তিযোগে করণ (সাদে শব্দের দ্বারা); বিভক্তির পরিবর্তে কিছু অনুসর্গের ব্যবহার (তোহোর অন্তরে তোর তরে) ইত্যাদি।

প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীন বাংলার বিস্তৃতিকাল আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। কারণ ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালপর্বে রচিত বাংলা ভাষার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাই এই পর্বটিকে ‘অনুর্বর পর্ব’ বা ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্ব’ বলা যায়।

(২) মধ্য বাংলা (Middle Bengali):

আনুমানিক ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই কালপর্বের বিস্তৃতি। বাংলা ভাষার এই মধ্য পর্বের বিস্তার সুদীর্ঘ প্রায় চারশ’ বছর। এই পর্বটিকে দুটি উপপর্বে ভাগ করা যায়-

(ক) আদিমধ্য বাংলা (Early Middle Bengali): এই কালপর্বের বিস্তার আনুমানিক ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর রচনাকাল বিতর্কিত হলেও মোটামুটিভাবে এই রচনাটিকেই আদিমধ্য পর্বের বাংলা ভাষার একমাত্র নিদর্শনরূপে ধরা হয়। এই পর্বের বাংলা ভাষার প্রধান বিশেষত্ব আ-কারের পরবর্তী ‘ই’/’উ’ ধ্বনির ক্ষীণতা, সর্বনামের কর্তৃকারকের বহুবচনে ‘-রা’ বিভক্তি (আহ্মরা > আমরা), ‘-ইল’-যোগে অতীত কালের ও ‘-ইব’ যোগে ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ গঠন (শুনিলোঁ, করিবোঁ), ‘আছ’ ধাতু যোগে যৌগিককালের পদসৃষ্টি (লই (আ)ছে > লইছে), পাদাকুলক-পাটিকা ছন্দ থেকে বহুপ্রচলিত পয়ার ছন্দের সৃষ্টি ইত্যাদি।

(খ) অন্ত্যমধ্য বাংলা (Late Middle Bengali): আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই কালপর্বের বিস্তৃতি। এই উপপর্বের ভাষার সমৃদ্ধ নিদর্শন মঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন ধারা, বৈষ্ণব সাহিত্যে রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের অনুবাদ ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। এই সময়ের বাংলা ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য একক ব্যঞ্জনের পরবর্তী পদান্তিক স্বরধ্বনির লোপ-প্রবণতা (রাম রাম্), অপিনিহিতি (কালি > কাইল, করিয়া > কইর‍্যা), বিশেষ্যের কর্তৃকারকের বহুবচনে ‘-রা’ বিভক্তি, নামধাতুর ব্যবহার (নমস্কার > নমস্কারিল), আরবি-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ও বৈষ্ণব কবিতায় ব্রজবুলি ভাষার ব্যবহার ইত্যাদি।

(৩) আধুনিক বাংলা (New Bengali):

আনুমানিক ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এই যুগপর্বের বিস্তৃতি। বাঙালির মুখের বাংলা ভাষাই এই পর্বের বাংলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকবৃন্দ ও খ্রিস্টান মিশনারীদের রচিত বাংলা গ্রন্থ, রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র- রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিকদের রচনায় এই আধুনিক বাংলার নিদর্শন পাওয়া যায়। সাহিত্যিক ভাষার এই নিদর্শনের পাশাপাশি, পাঁচটি উপভাষাও এই কালপর্বের অবদান। সেগুলো হল, মধ্য পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা ‘রাঢ়ী’, দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তবঙ্গের উপভাষা ‘ঝাড়খণ্ডী’, উত্তরবঙ্গের উপভাষা ‘বরেন্দ্রী’, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের উপভাষা ‘বঙ্গালী’ এবং উত্তরপূর্ব বঙ্গের উপভাষা ‘কামরূপী’ বা ‘রাজবংশী’।

এগুলির মধ্যে গঙ্গাতীরবর্তী তথা কলকাতার নিকটবর্তী পশ্চিমবাংলার রাঢ়ী উপভাষার উপরে ভিত্তি করেই শিক্ষিত জনের সর্বজনীন আদর্শ চলিত বাংলা বা Standard Collaquial Bengali-র রূপ গড়ে উঠেছে।

আধুনিক বাংলা ভাষার দুটি প্রধান বিশেষত্ব হল, সাহিত্যে ব্যবহৃত সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা এবং সাহিত্যে গদ্যরীতির ব্যাপক ব্যবহার।

এই স্তরে চলিত বাংলার প্রধান বিশেষত্ব হল- অভিশ্রুতি (করিয়া কইর‍্যা করে‍্য > করে), স্বরসঙ্গতি (দেশী > দিশি), বহুপদী ক্রিয়ারূপ (গান করা, জিজ্ঞাসা করা), ফারসি ‘ব’ (wa) থেকে আগত ‘ও’-এর সংযোজক অব্যয়রূপে ব্যবহার (রাম ও শ্যাম), বহু ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ, নতুন নতুন ছন্দোরীতি ও গদ্যছন্দের প্রতিষ্ঠা।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading