বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী সুলতানদের অবদানের মূল্যায়ন করো। (Assess the contributions of the Ilyas Shahi Sultans to the political and cultural History of Bengal.)

ইণ্ডিয়ার-উদ্দিন মহম্মদ-বিন্-বখতিয়ার খলজি বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। তাঁর সময় থেকে ইলিয়াস শাহী বংশের অভ্যুত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলার শাসকেরা কখনও স্বাধীন থেকেছেন, কখনও দিল্লি সুলতানির অধীনে থেকেছেন। 1328 খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ-বিন-তুঘলক মুসলিম অধিকৃত বাংলাকে তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলে একজন করে শাসক নিযুক্ত করেন। এই তিনটি বিভাগ ছিল-লক্ষণাবতী বা লখনৌতি, সাতগাঁও এবং সোনারগাঁও।

সোনারগাঁও-এর শাসনকর্তা বাহ্রাম শাহের মৃত্যু হলে (133৪ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর জনৈক অনুচর ফরউদ্দিন সোনারগাঁও-এর শাসনক্ষমতা দখল করেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই অবস্থায় অপর দুটি বিভাগের শাসনকর্তাদ্বয় কাদর খাঁ ও ইজুদ্দিন যুগ্মভাবে ফকরউদ্দিনকে আক্রমণ ও বিতাড়িত করেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই কাদর খাঁর মৃত্যু হলে তার জনৈক অনুচর আলি মোবারক লক্ষণাবতীর শাসনক্ষমতা দখল করেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যে মহম্মদ তুঘলকের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। এই সুযোগে হাজী ইলিয়াস শাহ মোবারককে পরাজিত করে লক্ষণাবতী সিংহাসন দখল করেন (1342 খ্রিস্টাব্দ)। পরের বছরই তিনি সোনারগাঁও দখল করে নেন। এইভাবে বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন শুরু হয়।

শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (1342-57 খ্রিস্টাব্দ): বাংলার সিংহাসনে বসে ইলিয়াস শাহ ‘শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’ উপাধি ধারণ করেন। যদুনাথ সরকার-এর ভাষায়- “ইলিয়াস শাহ লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল।” (A new chapter was opened in the history of Bengal with the accession of Ilyas Saha to the throne of Lakhnawati)। ইলিয়াস শাহ বাংলার ইতিহাসে দুশো বছরের স্বাধীন ও গৌরবময় সুলতানি যুগের সূচনা করেন। সিংহাসনে বসার পর ইলিয়াস শাহ রাজ্যবিস্তারে মন দেন। সাতগাঁও এবং সোনারগাঁও

দখলের পর তিনি বিহারের ত্রিহৃত আক্রমণ করেন এবং দখল করেন। তারপর একে একে গোরক্ষপুর, চম্পারণ ও বারাণসী অধিকার করেন। অতঃপর তিনি নেপাল আক্রমণ করেন (1346 খ্রিস্টাব্দ)। নেপালের কাঠমান্ডু দখল করে অবাধ লুণ্ঠন চালান। এরপর ওড়িশা আক্রমণ করেও তিনি প্রচুর ধনসম্পদ লাভ করেন।

ইলিয়াস শাহের সাফল্যে ও ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে সুলতান ফিরোজ তুঘলক বাংলাদেশ আক্রমণ করেন (1353 খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু ইলিয়াস শাহ সুলতানকে কোনোরূপ বাধা না দিয়ে দিনাজপুরের ‘একডালা দুর্গ’-এ আশ্রয় নেন। ফিরোজ শাহ বিনা বাধায় বাংলার রাজধানী দখল করার পর একডালা দুর্গ অবরোধ করেন। এই দুর্গটি ছিল দুর্ভেদ্য এবং চতুর্দিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। দীর্ঘদিন অবস্থান করেও একডালায় প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরোজশাহ দিল্লি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দুর্গ দখল করতে না পারলেও এই অবরোধের ফলে বাংলার প্রভৃত ক্ষতি হয়েছিল। ইলিয়াস বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ দু-বার দিল্লিতে ‘নজরানা’ প্রেরণ করেছিলেন। দিল্লির সঙ্গে শাস্তি স্থাপনের পর ইলিয়াস শাহ কামরূপ আক্রমণ করেন (1357 খ্রিস্টাব্দ)। তবে এই অভিযানের ফলাফল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

ইলিয়াস শাহ সুশাসক ছিলেন। তাঁর আমলে কেন্দ্রীয় শাসন যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠেছিল। তিনি পান্ডুয়াতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ওই সময় পান্ডুয়া শিল্পস্থাপত্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তিনি হাজীপুর শহরের প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফিরোজাবাদে একটি সুবিশাল জলাধার নির্মাণ করেন। ‘তারিখ-ই-মোবারক শাহী’ নামক প্রশ্ন অনুযায়ী 1358 খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান। কিন্তু বিভিন্ন মুদ্রা ইত্যাদি থেকে অনুমিত হয় 1357 খ্রিস্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান হয়েছিল।

সিকান্দর শাহ (1357-89 খ্রিস্টাব্দ): ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকন্দর শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। পিতার ন্যায় তিনিও ছিলেন সুযোদ্ধা, বিচক্ষণ ও সুদক্ষ প্রশাসক। তিনিও দিল্লির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি একাধিকবার উপটৌকনসহ দিল্লিতে দূত প্রেরণ করেন।

তত্সত্ত্বেও দিল্লির সঙ্গে তাঁর সংঘাত ঘটেছিল। ব্যর্থতার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ফিরোজ বিরাট বাহিনীসহ বাংলা অভিযান করেন (1359 খ্রিস্টাব্দ)। সিকদার পিতার মতোই একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এবারের দীর্ঘদিন অবরোধের পর ফিরোজ ফিরে যেতে বাধ্য হন। অবশ্য সিকন্দার ফিরোজ শাহকে কিছু উপটৌকন প্রেরণ করে

বন্ধুত্ব বজায় রাখেন। এরপর দীর্ঘকাল বাংলাদেশ দিল্লি সুলতানির অধীনতা মুক্ত থাকে। সিকন্দারের শেষ জীবন খুব কষ্টে কাটে। তাঁর পুত্রদের মধ্যে আত্মকলহ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত নিজ কনিষ্ঠ পুত্রের হাতেই তিনি নিহত হন (1289 খ্রিস্টাব্দ)।

সিকন্দারের শিল্পানুরাগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি পান্ডুয়াকে বহু সুদৃশ্য মসজিদ ও প্রাসাদে সুসজ্জিত করেন। পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ তাঁর এক অনবদ্য কীর্তি ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, আদিনা মসজিদের মতো এত বড়ো মসজিদ ভারতে আর কখনও নির্মিত হয়নি। এটি দামাস্কাসের বিশ্ববিখ্যাত মসজিদের সমতুলা ছিল। এ ছাড়া গৌড়ের ‘কোতোয়ালী দরওয়াজা’, যুগলির ‘মোল্লা সিমলা’ প্রভৃতি মসজিদ সিকন্দরের শৈল্পগ্রীতির পরিচয় বহন করে।

সিকন্দরের পরে সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র গিয়াসুদ্দিন আজম্ শাহ। তিনি ছিলেন বিশেষ জনপ্রিয় সুলতান। কামতাপুরের বিরুদ্ধে অভিযান করে তিনি ব্যর্থ হন। তবে চিন দেশের সঙ্গে তার দূত বিনিময় হয়। তাঁর আমলেই চৈনিক দোভাষী মা-হুয়ান বাংলাদেশে। আসেন। গিয়াসুদ্দিনের পর দুর্বল বংশধরদের আমলে সামন্তরাই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। এইরূপ পরিস্থিতিতে ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সুলতান শিহাবউদ্দিন বায়োজিদ শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে দিনাজপুরের জনৈক সামন্ত গণেশ বাংলার সিংহাসন দখল করেন। প্রায় আঠাশ বছর পর নাসিরুদ্দিন মামুদ বাংলাদেশে ইলিয়াস শাহী শাসনের পুনঃসূচনা করেন। 1487 খ্রিস্টাব্দে এই বাশের শেষ সুলতান জালালউদ্দিন ফতেশাহকে হত্যা করে জনৈক হাবসী ক্রীতদাস বাংলার সিংহাসন দখল করলে বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনের অবসান ঘটে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading