বাংলা গদ্যের প্রথম যুগের অন্যতম শিল্পী বিদ্যাসাগর। বাংলা গ্রন্থের প্রয়োজনে তাঁকে অনুবাদে নজর দিতে হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের অনুবাদমূলক রচনাগুলি হল হিন্দি ‘বৈতাল পচ্চসী’ থেকে ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭), কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ থেকে ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪), ভবভূতির ‘উত্তরচরিত’ ও বাল্মীকির রামায়ণের ‘উত্তরকান্ড’ অবলম্বনে লেখেন ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০); শেকসপিয়রের ‘Comedy of Errors’ অবলম্বনে ‘ভ্রান্তিবিলাস’; মার্শম্যানের ‘History of Bengal’ অবলম্বনে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৮৪৮); চেম্বার্সের ‘Biographies’ অবলম্বনে ‘জীবনচরিত’ (১৮৪৯)।
বিদ্যাসাগর বাঙালি জীবনের দিকে তাকিয়ে সহজ সরলভাবে অনুবাদে মন দেন। প্রথম গ্রন্থ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ থেকেই তা শুরু করেন। বিদ্যাসাগরের দুটি অন্যতম অনুবাদগ্রন্থ ‘শকুন্তলা’ ও ‘সীতার বনবাস’। কালিদাসের আদিরস বিসর্জন দিয়ে বিদ্যাসাগর শান্তরসের সমাহারে অনুবাদকে পূর্ণ করেছেন। বাঙালির শান্ত সমাহিত জীবনের কাব্য বিদ্যাসাগরের ‘শকুন্তলা’। ভাষার স্নিগ্ধতায় ও লালিত্যে সহজেই তা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন এই অংশটি-“বাছা শুনিলাম, আজ তোমার বড়ো অসুখ হয়েছিল; এখন কেমন আছ, কিছু উপশম হয়েছে? শকুন্তলা কহিলেন, হাঁ পিসি। আজ বড়ো অসুখ হয়েছিল, এখন অনেক ভালো আছি।” অন্যদিকে ‘সীতার বনবাস’-এ বাঙালির দাম্পত্য-প্রেম, ভ্রাতৃত্ব-প্রেম সহজভাবে গড়ে তুলেছেন।
বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই বাংলা গদ্য একটা সুনির্দিষ্ট ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠালাভ করে। অনুবাদের মধ্য দিয়ে তিনি যেমন বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন, তেমনি গদাও এগিয়ে যায়। সেদিন পাঠ্যপুস্তকের অভাব মিটিয়েছিল এই গ্রন্থগুলি। তেমনি যতিচিহ্নের সুনির্দিষ্ট ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলা গদ্যকে তিনি অনেকটা পথ এগিয়ে দেন। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-“বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্য সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।”