বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কাব্য কোনটি-
বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫–১৮৯৪) বাংলা কাব্যের আধুনিক যুগে অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য “সর্বসঙ্গ”। এটি ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয় এবং বাংলা সাহিত্য জগতে এক নতুন ধারার সূচনা করে। “সর্বসঙ্গ” কাব্যগ্রন্থে প্রকৃতি, মানবমনের অনুভূতি এবং গ্রাম্যজীবনের সরলতা ফুটে উঠেছে, যা তাঁকে “বাংলার ওয়ার্ডসওয়ার্থ” অভিধায় ভূষিত করেছে।
“সর্বসঙ্গ” কাব্যের বৈশিষ্ট্য:
১. প্রকৃতির প্রতি গভীর প্রেম:
বিহারীলালের “সর্বসঙ্গ” কাব্যে প্রকৃতির বর্ণনা এতটাই সরল ও স্বাভাবিক যে, পাঠককে সহজেই প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ জীবনের দৃশ্য, নদীর কলকল ধ্বনি, গাছের মর্মর ধ্বনি ইত্যাদি তাঁর কবিতায় গভীরভাবে ফুটে উঠেছে।
২. মানবীয় অনুভূতির গভীরতা:
“সর্বসঙ্গ”-এর কবিতাগুলো মানবমনের গভীর অনুভূতিকে সহজ ভাষায় প্রকাশ করে। তাঁর কবিতায় সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার মধ্যে মানবমনের আবেগ ফুটে ওঠে।
৩. সরল ভাষাশৈলী:
বিহারীলাল সরল ও মধুর ভাষায় তাঁর কবিতা রচনা করেছেন, যা তৎকালীন সংস্কৃতঘেঁষা ভাষার বিরোধিতা করে এক নতুন ধারার প্রচলন ঘটায়।
বাংলা কাব্যের ইতিহাসে গুরুত্ব:
১. রোমান্টিক ধারা প্রতিষ্ঠা:
বিহারীলাল বাংলা কাব্যে রোমান্টিক ধারার প্রথম সফল প্রবর্তক। প্রকৃতির বর্ণনা ও মানবমনের আবেগকে তিনি সুনিপুণভাবে মিশ্রিত করেছেন। তাঁর কবিতা পাঠককে প্রকৃতি ও জীবন সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
২. স্বাভাবিকতাবাদের সূচনা:
তাঁর রচনায় কৃত্রিমতার কোনো স্থান নেই। গ্রাম্যজীবন ও প্রকৃতির সরলতা তাঁর কবিতার প্রধান উপকরণ। এটি বাংলা কবিতায় স্বাভাবিকতাবাদী ধারা গঠনে ভূমিকা রাখে।
৩. প্রভাব:
বিহারীলালের কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ পরবর্তী অনেক কবি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাঁর কবিতার সরলতা ও প্রকৃতির বর্ণনা রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রতিফলিত হয়।
৪. গান্ধার ঐক্যের প্রতিচ্ছবি:
বিহারীলালের কবিতা শুধু সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তা সামাজিক ঐক্যের প্রতীকও। “সর্বসঙ্গ” কাব্যে গ্রাম ও শহরের জীবনচিত্র একই সঙ্গে উঠে এসেছে, যা সমগ্র বাঙালির জীবনের প্রতিফলন ঘটায়।
৫. সমসাময়িক প্রভাব:
তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে যখন সংস্কৃতঘেঁষা গদ্য-কবিতার আধিক্য, তখন বিহারীলালের রচনায় আধুনিকতার ছোঁয়া এনে এক নতুন সাহিত্যযুগের সূচনা হয়।
উপসংহার:
বিহারীলাল চক্রবর্তীর “সর্বসঙ্গ” কাব্য বাংলা সাহিত্য জগতে এক নতুন ধারা সূচনা করে, যেখানে প্রকৃতি ও মানবমনের সংযোগ গভীরভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। সরলতা ও রোমান্টিকতার সমন্বয়ে এই কাব্য বাংলা কাব্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় স্থান অধিকার করেছে। তাঁর রচনা কেবল তৎকালীন পাঠকসমাজেই নয়, পরবর্তী প্রজন্মের কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যেও গভীর প্রভাব বিস্তার করে।