উত্তরঃ সুশৃঙ্খল পঠন-পাঠনের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান কতগুলো অধ্যয়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। সমস্যার প্রকার ভেদে যে পদ্ধতি উপযোগী তা অনুসরণ করা হয়। সমাজ জীবনে পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যয়ন পদ্ধতি গতিশীল। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন পদ্ধতির কথা বলেছেন। এখানে সাধারণভাবে কয়েকটি স্বীকৃত পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি:- লর্ড ব্রাইস, ল্যাসওয়েল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনৈতিক বিষয়াদি অনুসন্ধানের জন্য পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ল্যাসওয়েল বলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞান নয় বরং তা পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞান (Political Science is primarily observational and nor experimental)। এ পদ্ধতির সাহায্যে আমরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে রাজনৈতিক নিয়ম-কানুন ও সূত্র উদ্ভাবন করতে সক্ষম হই।
লর্ড ব্রাইস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যাণ্ড, নিউজিল্যান্ড সফর করে এ সব দেশের সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করে নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। ব্রাইসের ‘The American Commonwealth এবং Modern Democracies নামক গ্রন্থ দু’টি পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিতে নগর রাষ্ট্রের সংবিধান বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি তার বিখ্যাত পলিটিকস গ্রন্থে রাষ্ট্রের উত্থান পতন সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করে মানব সমাজের জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে তার অনুসন্ধানের জন্য একটিমাত্র দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ নয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থার পর্যবেক্ষণের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের সঠিক চিত্র পাওয়া যায়। শুধু সাংবিধানিক আইনই যথেষ্ট নয়। সুতরাং রাজনৈতিক বিষয়গুলো আলোচনার ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিক পদ্ধতি:- রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় ঐতিহাসিক পদ্ধতি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফসল। প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী ইবনে খলদুন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্ল মার্কস ইতিহাস দর্শনের আলোকে সমাজকে ব্যাখা বিশ্লেষণ করেছেন। লাচ্ছি, লর্ড ব্রাইস, হেনরী মেইন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই পদ্ধতি অনুসরণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনেক মূল্যবান তথ্য সংযোজন করেছেন।
এ পদ্ধতির তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল যে এর মাধ্যমে অতীতের রাষ্ট্রীয় সংগঠনের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করে বর্তমান যুগের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ সাধন সম্ভব।
ঐতিহাসিক পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা বর্তমানকে সুষ্ঠভাবে জানতে পারি এবং ভবিষ্যৎ আদর্শ জীবনের দিক নির্দেশ দিতে পারি । এ পদ্ধতিকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলার জন্য পর্যবেক্ষণ ও তুলনামূলক পদ্ধতির সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। রাষ্ট্র সঠিক পথে পরিচালনা এবং কল্যাণকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এ পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম।
মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি:- মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের আচরণ ও ব্যবহার যথাযথভাবে বিচার বিশ্লেষণ না করতে পারলে সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে দাড়ায়। রাজনৈতিক দল, জনমত গঠন, আইন প্রণয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনসাধারণের মনোভাব লক্ষ্য করে কাজ করতে হয়। সম্প্রতি মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতির সাহায্যে রাষ্ট্রীয় অনেক জটিল সমস্যার
সমাধানের পথ খুঁজে বের করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জনগণের কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা পর্যালোচনা করা হয়।
আধুনিককালে গ্রাহাম ওয়ালাস, বেজহট প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই পদ্ধতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এরিস্টটল তাঁর Politics গ্রন্থে বিপ্লবের মনস্তাত্ত্বিক কারণ উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় জনসাধারণের মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে সফলতা অর্জন করা যায় না। মানুষের কাজ করার পেছনে যে উদ্দেশ্য থাকে মনোবিজ্ঞান তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে। কি কারণে দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাধে, আন্তর্জাতিক সংঘাতের সৃষ্টি হয় মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি দ্বারা তা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। মনোবিজ্ঞান মানুষের কাজের পেছনে যে উদ্দেশ্য থাকে তা জানার চেষ্টা করে।
পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি:- সম্প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। লরেন্স, লাওয়েলের জনমত ও জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থা’ এবং লিপম্যানের ‘জনমত’ গ্রন্থ এই পদ্ধতিকে আরো জনপ্রিয় করে তুলেছে। জনমত গঠন; ভোটদান প্রদ্ধতি, নির্বাচন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাজনীতির গতি প্রকৃতি পর্যলোচনা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনায় এই পদ্ধতি বিশেষভাবে কার্যকর। গবেষণা ও জরিপের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অধ্যাপক লাক্ষি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের শ্রেণীবিন্যাসের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে এই পদ্ধতির প্রয়োগে সফলতা অর্জন করেছেন ।
তুলনামূলক পদ্ধতি:- রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে তুলনামূলক পদ্ধতি একটি প্রাচীন পদ্ধতি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল তুলনামূলক পদ্ধতির প্রবর্তক। তিনি এই পদ্ধতির সার্থক ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্র, সরকার ও শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন বিষয়ের উপর গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব প্রদান করেছেন। বর্তমান যুগে রাজনীতি অধ্যয়নে এই পদ্ধতি খুবই জনপ্রিয়।
আলমন্ড ও কোলম্যান, ভারবা, এপটার, ডেভিড ইটন, লুসিয়ান পাই প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ তুলনামূলক পদ্ধতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই পদ্ধতির সুবিধা হল একসাথে অনেকগুলো রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার দোষ-গুণ নির্ণয় করা সহজ হয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রের উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয়ে উন্নততর শাসনপদ্ধতির কথা চিন্তা করা যায় এবং এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে নাগরিকের কল্যাণ সাধন সম্ভব।
সাক্ষাৎকার পদ্ধতি:- কোন রাজনৈতিক ঘটনার কারণ ও ফলাফল অনুসন্ধানে সাক্ষাৎকার পদ্ধতি খুবই কার্যকর। বর্তমানে এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী যে কোন বিষয়ে জনসাধারণের নিকট থেকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। অনেক সময় সরকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এই প্রদ্ধতির মাধ্যমে জনমতের গতি প্রকৃতি যাচাই করে থাকে। এভাবে নির্ধারিত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে জনমত যাচাই করা যায়। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় ভবিষ্যৎবাণী করার জন্য সাক্ষাৎকার পদ্ধতির কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে।