ভারতের সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি আলোচনা করো।
ভারতের সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি:
সংবিধান লিখিত বা অলিখিত যাই হোক-না-কেন দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানেরও পরিবর্তন বা সংশোধন প্রয়োজন। পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্ণে সংবিধান সাযুজ্যপূর্ণ না হলে দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রেও বর্তমানে কোনো দেশের সংবিধানের পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। লর্ড ব্রাইস পদ্ধতিগত দিক থেকে সংবিধান সংশোধন পদ্ধতিকে দু-ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-সুপরিবর্তনীয় সংবিধান এবং দুস্পরিবর্তনীয় সংবিধান। যে সংবিধান সাধারণ অচিনপ্রণয়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে পরিবর্তন করা হয়, তাকে বলে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান। যেমন-যুক্তরাজ্যের সংবিধান। আবার যে সংবিধান বিশেষ পদ্ধতির রীতি অনুসরণ করে পরিবর্তন করা হয়,
তাকে বলে দুস্পরিবর্তনীয় সংবিধান। যেমন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। ভারতের সংবিধান লিখিত। কিন্তু ভারতের সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির ক্ষেত্রে যেমন সম্পূর্ণভাবে সুপরিবর্তনীয় রীতি গ্রহণ করা হয়নি, তেফাই সম্পূর্ণভাবে দুস্পরিবর্তনীয় রীতিও গ্রহণ করা হয়নি। এখানে সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে সুপরিবর্তনীয় ও দুস্পরিবর্তনীয়তার মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। অর্থাৎ সংবিধানের কোনো কোনো ধারা সাধারণ আইনপ্রণয়ন পদ্ধতির দ্বারা সংশোধিত হয়। আবার কোনো কোনো ধারা পরিবর্তন বা সংশোধন করতে গেলে ‘বিশেষ পদ্ধতি’ অবলম্বন করতে হয়। ভারতের সংবিধানের 36৪ নং ধারায় সংবিধান সংশোধন পদ্ধতিটি লিপিবদ্ধ আছে।
সংবিধানের 368 নং ধারা:
সংবিধানের 368 নং ধারা অনুসারে সংবিধান সংশোধনের তিনটি আছে। এর দ্বারা বোঝা যায় যে, ডারতে সংসদ কেবল আইনপ্রণয়নের গতানুগতিক ক্ষমতাই ভোগ করে না, সংসদের বিশেষ কিছু সাংবিধানিক জমতাও ভোগ করে। সেই বিশেষ তিনটি পদ্ধতি বা ক্ষমতা হল-
সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট দ্বারা সংশোধন:
সংবিধানের এমন কতকগুলি ধারা আছে যা সংসদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে এককভাবে সংশোধন করা যায়। অর্থাৎ, এখানে বিশেষ পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। শুধু সাধারণ বিল পাসের পদ্ধতি অবলম্বন করলেই চলে। সংসদের উভয়কক্ষে সংশোধনী বিলটি গৃহীত হলে তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি ওই বিলে সম্মতি জানালে তা আইনে পরিণত হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে সংশোধনের ক্ষেত্রে সংসদের বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অথবা প্রাদেশিক আইনসভাগুলির সম্মতির দরকার হয় না।
এই পদ্ধতি অনুসারে যেসব ধারার পরিবর্তন করা যায়, তা হল-
[a] নতুন রাজ্য গঠন কিংবা রাজ্য পুনর্গঠন কিংবা পুরাতন রাজোর সীমানা অথবা রাজ্যের নাম পরিবর্তন:
[b] প্রাদেশিক আইনগুলির দ্বিতীয় কক্ষ বা উচ্চককের (বিধান পরিষদের) সৃষ্টি অথবা বিরুক্তি
[c] সংসদের সদস্যগণদের বিশেষ অধিকারসমূহ;
(d) সংসদের ‘কোরাম’ অর্থাৎ ন্যূনতম উপস্থিতি-সীমা বিষয়ক নিয়মের পরিবর্তন;
[d] সংসদের সদস্যগণদের বেতন ও ভাতা সংক্রান্ত বিষয়:
[f] সুপ্রিমকোর্টের এক্তিয়ার বৃদ্ধির বিষয়; এ। ভারতের সরকারি ডাষা সংক্রান্ত বিষয়;
[g] ভারতে নির্বাচন এবং নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়; ( ভারতের নাগরিকতা সং ক্লান্ত বিষয়।
[h] কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সম্পর্কিত বিষয়:
[k] তপশিলি জাতি এবং উপজাতি অঞ্চল সম্পর্কিত বিষয়সমূহ।
সংসদের উভয়কক্ষের ভোষ্ট দ্বারা সংশোধন:
সংবিধানের এমন কিছু অংশ বা ধারা আছে, যেগুলিকে পরিবর্তন বা সংশোধন করতে গেলে সংসদের উভয়কক্ষেই মোট সদস্যের বেশিরভাগ এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন একান্তভাবেই দরকার হয়। এইভাবে সংসদের প্রত্যেকটি কক্ষ দ্বারা যদি সমর্থিত হয় তাহলে বিলটিকে রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর সম্মতিলাডের জন্য পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করলে বিলটি গৃহীত হয়েছে বা আইনে পরিণত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এ পদ্ধতি অনুসারে যেসব ধারার পরিবর্তন বা সংশোধন করা যায়, তা হল- (a) সংবিধানের তৃতীয় অংশে (Part-4) বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলি এবং সংবিধানের চতুর্থ অংশে (Part-IV) বর্ণিত নির্দেশমূলক নীতিগুলি: [৮] তা ছাড়া, প্রথম ও শেষ পদ্ধতি দৃষ্টিতে বর্ণিত যেসব ধারা সংশোধন করা যায়, সেগুলি বাদে অন্যান্য অংশগুলি এই পদ্ধতি দ্বারা সংশোধিত হবে।
সংসদের উভয়কক্ষ ও রাজ্য আইনসভা কর্তৃক সংশোধন:
সংবিধানের এমন কিছু অংশ বা ধারা আছে যেগুলি সংশোধন বা পরিবর্তনের সময় সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবটিকে সংসদের প্রতিটি কন্ধের মোট সদস্যদের বেশির ভাগ এবং উপস্থিত ও ভোটপ্রদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ দ্বারা সমর্থন লাড করতে হবে। এই পদ্ধতি অনুসারে সংসদের উভয়কক্ষের সমর্থন পায়, তাহলে সমর্থিত বিলটিকে অলরাজাপুলির আইনসভাসমূহের কাছে অনুমোদন পাওয়ার জন্য পাঠানো হয়। এরপর রাজ্য আইনসভাগুলির অর্ধেক সদস্য যদি প্রভাবিত বিলটিকে সমর্থন করেন তাহলে ওই সমর্থিত বিলটিকে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি জানালে তা আইনে পরিণত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, সংবিধানের 24 তম সংশোধনী আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতি যে-কোনো ধরনের সংবিধান সংশোধনীতে অসম্মতি জানাতে পারেন না। এই পদ্ধতি অনুসারে সংশোধন করা যায় এমন বিষয়গুলি হল- (১) রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়; (b) কেন্দ্র এবং অঙ্গরাজ্যগুলির শাসনতান্ত্রিক এলাকা সংক্রান্ত বিষয়: (c) সুপ্রিমকোর্ট এবং অলরাজ্যগুলির হাইকোর্ট সম্পর্কিত বিষয়; [d] 36৪ নং ধারায় উল্লিখিত সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি সম্পর্কিত বিষয়সমূহ ইত্যাদি।
মূল্যায়ন
ভারতের সংবিধান সংশোধন পদ্ধতিটি নানা দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। যথা-
যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি লঙ্ঘন:
ডারতে সংবিধান সংশোধন পদ্ধতিটি যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিকে লঙ্ঘন করে। কারণ সংশোধনী বিল উত্থাপনের অধিকার রয়েছে শুধু সংসদের অথবা সংসদের কোনো সদস্যের। সেখানে রাজ্য আইনসভা অথবা রাজ্য অহিনসভার কোনো সদস্য সংশোধনী প্রস্তাব আনতে পারেন না।
কতকগুলি ক্ষেত্রে কেন্দ্রের একক ক্ষমতা:
এমন কতকগুলি জ্বের আছে, যেখানে কেন্দ্রেই এককভাবে ক্ষমতার অধিকারী। রাজ্যগুলি সেখানে বঞ্চিত। যেমন-রাজ্য গঠন, পুনর্গঠন, রাজ্যের নাম ও সীমানাপরিবর্তন প্রভৃতি।
বিধান পরিষদের ব্যাপারে রাজ্যগুলিকে বঞ্চনা:
কোনো অঙ্গরাজ্যের বিধান পরিষদের সৃষ্টি বা বিলোপের ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যের আইনসভার হাতে কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কোনো অঙ্গরাজ্যের বিধান পরিষদের সৃষ্টি বা বিলোপ সংক্রান্ত প্রভাব সংসদ যদি আটকে রাখে, তাহলে তার প্রতিকার কী হতে পারে, সে সম্পর্কে 368 নং ধারায় কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায় যে, শঙ্করীপ্রসাদ মামলায় (1951) সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানে 368 নং ধারায় বর্ণিত বিষয়টিকে সম্পূর্ণ বিধি বলে মনে করেননি। এ ব্যাপারে অসম্পূর্ণতা রয়েছে