ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার তাৎপর্য:
ভারতের সংবিধানে বর্ণিত প্রস্তাবনাটি দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে সংবিধানের আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষা। মূলত, সংবিধানের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর জন্য প্রস্তাবনাটি সংযোজিত। প্রস্তাবনায় বর্ণিত বিষয়গুলি দ্বারা জনগণের সার্বভৌমিকতার
মূলসূত্রটি ধ্বনিত হয়েছে। সরকার পরিচালনার কোনো বিষয় কিংবা সংবিধানের ধারাগুলিকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ প্রস্তাবনায় বর্ণিত হয়নি। অর্থাৎ, সংবিধানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রস্তাবনাটি সংশ্লিষ্ট নাহলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
আইনগত তাৎপর্য:
প্রস্তাবনাকে সংবিধানের কার্যকরী অংশ বলা যায় না। সংবিধান হল একটি আইনগত দলিল। প্রভাবনাটি এই দলিলের পূর্বে সংযোজিত হয়েছে। তথাপি বলা যায় যে, যদি সংবিধানের কার্যকরী অংশের ব্যাখ্যা দানকালে কোনো শব্দ বা বাক্যের অর্থ স্পষ্ট না হয় তাহলে সেই শব্দ বা বাক্যের অস্পষ্টতা দূরীকরণের জন্য প্রভাবনার সাহায্য নেওয়া যায়। তবে যেসব ক্ষেত্রে সংবিধানের অর্থ বা শব্দ বা বাক্য স্পষ্ট, সেখানে প্রস্তাবনা দ্বারা ওই কার্যকরী অংশকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সংবিধানের কার্যকরী অংশ দ্বারা সরকার গঠন, পরিচালনা, সরকারের এক্তিয়ার প্রভৃতি নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়। কিন্তু সংবিধানের প্রস্তাবনায় যেসব নীতি ঘোষিত হয়েছে, তা কার্যকর করা সরকারের ইচ্ছাধীন ব্যাপার।
রাজনৈতিক তাৎপর্য:
যে সকল উদারনৈতিক ভাবধারা, বিবর্তনবাদী ও মিশ্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংবিধান রচয়িতাদের প্রভাবিত করেছিল, তারই প্রতিফলন ঘটেছে সংবিধানের প্রস্তাবনায়। তাঁরা চেয়েছিলেন ভারতকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করতে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার দিকে তাঁরা দৃষ্টিপাত করেছিলেন। তাই প্রম্ভাবনার দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে জনগণের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের কথা এরই পাশাপাশি ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোর আদর্শ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসমূহ এবং নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণের অধিকারও প্রকাশিত হয়েছে। জনগণ দ্বারা জনগণের সরকার গঠন, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠন ও ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার অঙ্গীকার, সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষার অধিকার প্রভৃতি সংবিধানের রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে। প্রস্তাবনায় বর্ণিত ‘সার্বভৌম’ শব্দটি দ্বারা কেবল রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ক্ষমতাকেই প্রকাশ করে না-এর দ্বারা গণসার্বভৌমিকতার ধারণাটিও প্রকাশ পেয়েছে।
সামাজিক তাৎপর্য:
প্রস্তাবনা দ্বারা সামাজিক ন্যায়নীতির বিষয়টিও প্রকাশিত হয়েছে। সংবিধানের মূল অংশে সমাজের দুর্বলতর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা, নারীদের সুযোগসুবিধা দান, শিশুদের অধিকারের সযত্ন-সংরক্ষণ, নারী- পুরুষের সমমজুরি ব্যবস্থা চালু করা, শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগসুবিধা প্রদান প্রভৃতি যে সামাজিক ন্যায়নীতি ঘোষিত হয়েছে, তা প্রস্তাবনায় বর্ণিত ‘ন্যায়বিচার’ (justice) শব্দটি দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে।
অথর্থনৈতিক তাৎপর্য:
সংবিধানের প্রস্তাবনায় অর্থনৈতিক ন্যায় সংক্রান্ত বিষয়টি ঘোষিত হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাস্তব কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। তবে প্রস্তাবনায় বর্ণিত ‘অর্থনৈতিক’ শব্দটি এমনভাবে ব্যস্ত হয়েছে, যার দ্বারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থনৈতিক অবিচার থেকে মুক্তির জন্য এক সংগ্রামী পথ গ্রহণ করার অনুপ্রেরণা লাভ করবে। সম্পদের যাতে কেন্দ্রীকরণ না ঘটে, যাতে জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন হতে পারে, কাজের যথাযথ পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে এবং জীবনযাত্রার মান গড়ে উঠতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখার অঙ্গীকার প্রস্তাবনায় ঘোষিত হয়েছে
আদর্শগত তাৎপর্য:
প্রস্তাবনা দ্বারা ভারতের সংবিধানের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শ প্রকাশিত হয়েছে। কীভাবে ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে জনকল্যাণ দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায়, তার আদর্শগত ভাবটি প্রকাশিত হয়েছে প্রস্তাবনার মধ্যে। প্রস্তাবনার মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে সংবিধান প্রণেতাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও চিন্তাধারা। অন্যভাবে বলা যায়, যে কার্যধারা সংবিধানের মূল অংশে বিভিন্ন ধারার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই মূল্যবোধ ও চিন্তাধারাই ব্যক্ত হয়েছে প্রস্তাবনার মধ্যে। উপসংহার: সংবিধানের কার্যকরী অংশের একটি সারাংশ হল সংবিধানের প্রস্তাবনা। ক্ষমতাসীন সরকারের দায়বদ্ধতা হল জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠা। এই কার্য সম্পাদনের জন্য গণতান্ত্রিক ন্যায় ও সামাজিক ন্যায়ের ধারা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে সরকার। নৈতিক দিক থেকে তাই জনকল্যাগের মূলসূত্রটি প্রস্তাবনার মধ্যে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রস্তাবনার নৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম।