‘মেঘদূত’ প্রবন্ধে রামগিরি থেকে হিমালয় পর্যন্ত যে যাত্রাপথের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার পরিচয় দাও।

“মেঘদূত” প্রবন্ধে কালিদাস তাঁর কাব্যিক রচনা ‘মেঘদূত’এর মধ্য দিয়ে এক অসাধারণ যাত্রাপথের বর্ণনা করেছেন, যা রামগিরি পর্বত থেকে শুরু করে হিমালয়ের আকাশছোঁয়া শৃঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ যাত্রাপথে বিভিন্ন ভূদৃশ্য, শহর, গ্রাম, নদী, পর্বত এবং পল্লীর বর্ণনা এক মহাকাব্যিক সৌন্দর্যে রূপ লাভ করেছে। প্রবন্ধে মেঘের মাধ্যমে পাঠককে এক কল্পনাময়, মনোরম ও আবেগপূর্ণ পরিবেশে ভ্রমণ করানো হয়েছে।

কালিদাসের কাব্যের নায়ক, যে একজন যক্ষ, তার প্রিয়াকে নিজের মনের বেদনাবিধুর কথা জানাতে এক মেঘকে দূত হিসেবে বেছে নেয়। যক্ষ মেঘের মাধ্যমে তাঁর প্রেয়সীর কাছে বার্তা পাঠাতে চান এবং এই পথেই আমরা রামগিরি থেকে হিমালয় পর্যন্ত এক রোমাঞ্চকর ভ্রমণ সম্পন্ন করি।

১. রামগিরি: যাত্রার সূচনা

যাত্রা শুরু হয় রামগিরি থেকে, যেখানে যক্ষ তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন। রামগিরি পর্বতের পরিবেশ অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর এবং তার আশেপাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উজ্জ্বল। এখানে কালিদাস একদিকে যক্ষের বিষণ্ণতাকে চিত্রিত করেন, অন্যদিকে পর্বতের অমলিন প্রকৃতি, প্রবাহিত নদী, আর চারপাশের শান্ত পরিবেশ যেন তাকে শান্তনা দিতে চায়।

২. মালভূমির উপর দিয়ে যাত্রা

মেঘদূত রামগিরি থেকে উড়ে চলে এবং সমতল ভূমি ও মালভূমির উপর দিয়ে এগোতে থাকে। এখানে মাঠের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো এবং সবুজ ফসলের মাঠ এক অত্যাশ্চর্য দৃশ্যের সৃষ্টি করে। মেঘ যেন মাঠের উপর ছায়া ফেলে বয়ে যাচ্ছে, আর নীচের মানুষের জীবনযাত্রা এর সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। কালিদাস এখানে জনজীবনের ছবি তুলে ধরেছেন, যা মেঘের চলার পথে বিশেষ এক বৈচিত্র্য এনে দেয়।

৩. বিন্ধ্য পর্বত

এরপর মেঘ বিন্ধ্য পর্বতে পৌঁছায়। বিন্ধ্য পর্বতের চূড়া এবং তার অনন্য সৌন্দর্য কালিদাস বর্ণনা করেছেন মুগ্ধতাপূর্ণভাবে। এখানে বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ, হরিণদের কৌতুকপূর্ণ ছুটোছুটি, আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের কলকাকলি এক মায়াময় আবহ সৃষ্টি করে। কালিদাস বিন্ধ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে তার প্রকৃতির সঙ্গে যক্ষের অভিলাষের তুলনা করেন। মেঘ বিন্ধ্যের উপর দিয়ে আসার সময় সেখানে যেন আশ্রয় খুঁজে পায় এবং কিছুক্ষণ থেমে যায়।

৪. নর্মদা নদীর সৌন্দর্য

যাত্রাপথে মেঘ নর্মদা নদীর উপরে এসে পৌঁছায়। নর্মদার স্বচ্ছ জল, উচ্ছল স্রোত, আর দুই পাড়ের সৌন্দর্য যেন মেঘকে কিছুক্ষণ আটকে রাখতে চায়। নদীর স্রোতকে কালিদাস তুলনা করেন যক্ষের মনের প্রবল আবেগের সঙ্গে, যা প্রিয়জনের জন্য অধীর। নর্মদার আশেপাশের গাছপালা, তার বিশালতা আর নির্জনতা যেন মেঘের সাথে মেলবন্ধন ঘটায়। মেঘ এখানে নিজের গতি কিছুটা শ্লথ করে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করে।

৫. উজ্জয়িনী নগরী

এরপর মেঘ উজ্জয়িনী নগরীর দিকে অগ্রসর হয়। উজ্জয়িনী নগরী, যা তখনকার গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐশ্বর্যশালী শহর ছিল, এখানে সে সৌন্দর্যের এক নতুন মাত্রা যোগ করে। উজ্জয়িনীর রাজপ্রাসাদ, নগরবাসীর আভিজাত্যপূর্ণ জীবনযাত্রা, সুরম্য উদ্যান, এবং নাগরিক উৎসবের বর্ণনা মেঘদূতের এই অংশে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। কালিদাস উজ্জয়িনীর চিত্রকে প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং রাজকীয় গৌরবের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন।

৬. শিপ্রা নদী ও মন্দির

মেঘ এখানে শিপ্রা নদীর পাশে অবস্থিত মন্দিরগুলির পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। শিপ্রার জলধারা এবং তার কূলে স্থাপিত মন্দিরগুলি যেন মেঘকে নতুন করে আধ্যাত্মিকতায় ভরিয়ে তোলে। মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, পূজারীদের মন্ত্রোচ্চারণ এবং ফুলের সুগন্ধি মেঘের চলার পথে এক নতুন ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এই ধর্মীয় স্থানে এসে যক্ষের বার্তা যেন আরও গভীর ভক্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

৭. কণ্ঠাপুর নগরী

কণ্ঠাপুর নগরীর পাশ দিয়ে যাত্রা করার সময় মেঘ এখানে বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলী, উদ্যান এবং স্থানীয় মানুষের জীবনের সাথে পরিচিত হয়। নগরজীবনের উৎসবমুখর পরিবেশ, কণ্ঠাপুরের রমণীদের অলঙ্কার এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মেঘকে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করে তোলে। নগরীর কোলাহলপূর্ণ জীবন এবং মানুষের প্রাকৃতিক মিলন যেন যক্ষের মনের আরও কাছাকাছি আসে।

৮. অলকাপুরী ও হিমালয়ের চূড়া

অবশেষে মেঘ যাত্রার শেষ প্রান্তে অলকাপুরীতে পৌঁছায়, যেখানে যক্ষের প্রেয়সী অপেক্ষা করছে। অলকাপুরী হিমালয়ের বুকে অবস্থিত এক কাল্পনিক নগরী, যা দেবলোকের সমতুল্য সুন্দর। অলকাপুরীর স্ফটিকের মতো ঝলমলে সৌন্দর্য, প্রেয়সীর বাসভবন এবং চারপাশের প্রকৃতি এক পবিত্র পরিবেশের সঞ্চার করে। মেঘ এখানে যক্ষের প্রেয়সীর কাছে পৌঁছায় এবং তার বার্তা পৌঁছায়।

এই যাত্রাপথের বর্ণনা কালিদাস কাব্যের রসে সিক্ত করে পাঠককে এক রোমান্টিক, ভক্তিমূলক, এবং গভীর আবেগপূর্ণ পরিবেশে নিয়ে যান।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading