রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব আলোচনা কর।  Discuss the theory of social contract regarding the origin of the state.

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব

সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব (Social Contract Theory) রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং তার ভিত্তি বোঝার একটি ঐতিহাসিক ও দার্শনিক পদ্ধতি। এই তত্ত্বে বলা হয় যে রাষ্ট্র এবং শাসনব্যবস্থা গঠিত হয়েছে ব্যক্তিদের মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, যা রাষ্ট্র, সরকার এবং মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণ প্রদান করে।

সামাজিক চুক্তির তত্ত্বের পটভূমি

সামাজিক চুক্তির তত্ত্বটি প্রাচীন যুগ থেকেই বিদ্যমান থাকলেও আধুনিক অর্থে এটি ১৬শ এবং ১৭শ শতকের দার্শনিকদের হাতে গড়ে উঠেছে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের লেখায় এর পূর্বাভাস পাওয়া যায়। তবে, থমাস হবস, জন লক এবং জাঁ জ্যাক রুশো এই তত্ত্বের আধুনিক রূপদানকারী। তাদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক চুক্তির তত্ত্বকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করেছে।

সামাজিক চুক্তির তত্ত্বের প্রধান দার্শনিকরা

১. থমাস হবস (Thomas Hobbes)

থমাস হবস তার বিখ্যাত গ্রন্থ Leviathan (১৬৫১) এ সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে “প্রাকৃতিক অবস্থা” (State of Nature) ধারণার কথা বলেছেন।

প্রাকৃতিক অবস্থা:

হবসের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক এবং নিজেদের রক্ষার্থে সর্বদা সংঘর্ষে লিপ্ত থাকত। এ অবস্থায় জীবন ছিল “নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, কদর্য, বর্বর এবং সংক্ষিপ্ত”। মানুষ নিজেদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য একটি সামাজিক চুক্তি করেছিল।

সামাজিক চুক্তি:

এই চুক্তির মাধ্যমে মানুষ তাদের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ত্যাগ করে একটি সর্বশক্তিমান কর্তৃপক্ষ বা সার্বভৌম (Sovereign) গঠনের জন্য একমত হয়। হবসের মতে, এই সার্বভৌম শক্তি একটি শক্তিশালী শাসক বা সরকার হতে পারে, যার মূল কাজ হলো শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি:

হবস বিশ্বাস করতেন যে একমাত্র শক্তিশালী এবং সর্বক্ষমতাশালী সার্বভৌমই সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব চূড়ান্ত এবং তা প্রশ্নাতীত।

২. জন লক (John Locke)

জন লক তার গ্রন্থ Two Treatises of Government (১৬৯০)-এ সামাজিক চুক্তি সম্পর্কে তার মতামত প্রদান করেছেন। তিনি হবসের তুলনায় একটি ভিন্ন এবং আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন।

প্রাকৃতিক অবস্থা:

লকের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ ছিল যুক্তিসংগত, শান্তিপ্রিয় এবং প্রাকৃতিক অধিকারের (Natural Rights) প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে, কোনো নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ না থাকায় অধিকারগুলোর লঙ্ঘন এবং সংঘাতের সম্ভাবনা ছিল।

সামাজিক চুক্তি:

মানুষ নিজেদের প্রাকৃতিক অধিকার (জীবন, স্বাধীনতা, এবং সম্পত্তি) রক্ষার জন্য একটি সামাজিক চুক্তি করে এবং একটি সরকার গঠন করে। তবে, এই চুক্তি হবসের মতো নিরঙ্কুশ শাসনের পক্ষে নয়। লকের মতে, সরকার জনগণের অনুমতির ভিত্তিতে কাজ করে।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি:

লকের মতে, রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো নাগরিকদের প্রাকৃতিক অধিকার রক্ষা করা। যদি সরকার এই অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে জনগণের অধিকার আছে সেই সরকারকে অপসারণ করার। এই ধারণাটি পরবর্তীতে গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক শাসনের ভিত্তি তৈরি করেছে।

৩. জাঁ জ্যাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau)

রুশো তার গ্রন্থ The Social Contract (১৭৬২)-এ সামাজিক চুক্তি নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং বৈধতা সম্পর্কে একটি নতুন এবং বিপ্লবী ধারণা প্রদান করেন।

প্রাকৃতিক অবস্থা:

রুশোর মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ নিরপরাধ, স্বাধীন এবং সুখী ছিল। কিন্তু সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে বৈষম্য, লোভ এবং শোষণ শুরু হয়, যা মানুষকে রাষ্ট্র গঠনে বাধ্য করে।

সামাজিক চুক্তি:

রুশো বলেন, মানুষ তাদের স্বাধীনতা ত্যাগ করে একটি “সাধারণ ইচ্ছা” (General Will)-র প্রতিষ্ঠা করে, যা জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত। এই চুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তির ইচ্ছার পরিবর্তে সমাজের মঙ্গলের প্রতি অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি:

রুশোর মতে, রাষ্ট্র জনগণের সাধারণ ইচ্ছার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এবং এটি সমানাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। তিনি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে জনগণ সরাসরি সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেবে।

সামাজিক চুক্তির তত্ত্বের গুরুত্ব

১. রাষ্ট্রের উৎপত্তি বোঝার ভিত্তি: সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বৈধতা এবং শাসনের ভিত্তি ব্যাখ্যা করে।

২. গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার: জন লক এবং রুশোর দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং সাম্যবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

৩. আইনের শাসনের ধারণা: এই তত্ত্ব রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত করতে আইনের শাসনের গুরুত্ব তুলে ধরে।

৪. স্বাধীনতা এবং অধিকার: মানুষের স্বাধীনতা এবং প্রাকৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য একটি নৈতিক ভিত্তি প্রদান করে।

সামাজিক চুক্তির তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা

১. প্রাকৃতিক অবস্থার ধারণা: প্রাকৃতিক অবস্থা সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এটি একটি কাল্পনিক ধারণা।

২. সর্বশক্তিমান শাসকের ধারণা: হবসের ধারণায় সার্বভৌমের নিরঙ্কুশ শক্তি আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

৩. সাম্য ন্যায়বিচারের অভাব: রুশোর সাধারণ ইচ্ছার ধারণা কখনও কখনও সংখ্যালঘুদের অধিকার উপেক্ষা করতে পারে।

৪. বাস্তবতার অভাব: সামাজিক চুক্তির ধারণা তত্ত্বগতভাবে আকর্ষণীয় হলেও বাস্তব রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং কার্যপ্রণালীর সঙ্গে এর পুরোপুরি মিল নেই।

উপসংহার

সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব রাষ্ট্র, সমাজ এবং নাগরিকদের সম্পর্ক বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ভিত্তি প্রদান করে। এটি রাষ্ট্রের বৈধতা, নাগরিকদের অধিকার, এবং শাসকের দায়িত্ব সম্পর্কে মূল্যবান ধারণা দেয়। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবুও এই তত্ত্ব আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। হবস, লক, এবং রুশোর চিন্তাধারা পরস্পর ভিন্ন হলেও তারা একত্রে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করেছেন যা আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading