রোমান্টিকতাবাদের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে অনেক পণ্ডিত বলেছেন যে তা মূলত ‘মধ্যযুগের পূর্ণজাগরণ’। রোমান্টিকতাবাদের ক্রমবিবর্তন আলোচনা করে এই মতবাদের কেন্দ্রীয় লক্ষণগুলি পরিস্ফুট করো।

রোমান্টিকতাবাদ বা রোমান্টিসিজম (Romanticism) হল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন যা ১৮শ শতকের শেষের দিকে এবং ১৯শ শতকের শুরুতে ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। এটি মধ্যযুগের চেতনা এবং দর্শনের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টাকে চিহ্নিত করে, এবং নতুন একটি সাহিত্যিক ও শিল্পকলা আন্দোলনের জন্ম দেয়। রোমান্টিকতাবাদের ক্রমবিবর্তন এবং এর কেন্দ্রীয় লক্ষণগুলি নিম্নে আলোচনা করা হলো:

রোমান্টিকতাবাদের ক্রমবিবর্তন

১. প্রাক-রোমান্টিক যুগ (১৭শ শতক)

রোমান্টিকতাবাদের প্রাথমিক লক্ষণগুলি মধ্যযুগের সাহিত্য, শিল্প ও দর্শন থেকে এসেছে। এসময় বিদ্রোহী চিন্তা এবং প্রকৃতির প্রতি এক নতুন ধরনের আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। সেন্ট জনসন, এবং আলেক্সান্ডার পোপের কাজগুলিতে প্রাক-রোমান্টিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেখানে তারা প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং মানবজীবনের মৌলিক অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেন।

২. রোমান্টিক যুগের সূচনা (১৮শ শতকের শেষ)

রোমান্টিক আন্দোলন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একযোগে শুরু হয়। জার্মানিতে, ইম্মানুয়েল কান্টের দর্শন এবং ফ্রিডরিশ শ্লেগেলের কাজগুলিতে নতুন ধরনের সৃজনশীলতা এবং স্বতন্ত্র চিন্তা প্রকাশিত হয়। ইংল্যান্ডে, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের কাজ রোমান্টিকতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রান্সে, ভিক্টর হুগো ও আলফঁস দে লামার্টিনের কাজ রোমান্টিক সাহিত্যের নতুন পথে সূচনা করে।

৩. রোমান্টিক আন্দোলনের বিকাশ (১৯শ শতকের শুরু)

১৯শ শতকের প্রথম দিকে রোমান্টিকতাবাদ আরও বিস্তৃত হয়। এতে নতুন নতুন মতাদর্শ এবং শিল্পের ধারণা যুক্ত হয়। বিশেষ করে, নাটক, উপন্যাস, এবং কবিতায় রোমান্টিকতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। রোমান্টিক কাব্যিকতা ও উপন্যাসে গভীর অনুভূতি, কল্পনা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গুরুত্ব বেড়ে যায়।

রোমান্টিকতাবাদের কেন্দ্রীয় লক্ষণগুলি

১. প্রকৃতি এবং এর সৌন্দর্য

রোমান্টিকতাবাদ প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং এর আত্মিক গুরুত্বকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। প্রকৃতিকে একজন জীবন্ত সত্তা হিসেবে দেখার প্রবণতা ছিল, যেখানে প্রকৃতি মানুষের অনুভূতির প্রতিবিম্ব হিসেবে কাজ করে। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য ও প্রভাব বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে।

২. কল্পনা এবং অনুভূতি

রোমান্টিক কবিরা যুক্তি ও যুক্তিবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কল্পনা ও অনুভূতির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা মনে করতেন যে, কল্পনা মানুষের মনের অগাধ গভীরতা প্রকাশের মাধ্যম এবং এই কল্পনা মানুষের অভ্যন্তরীণ সত্যকে তুলে ধরে। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ এবং জন কিটসের কবিতায় এই কল্পনা ও অনুভূতির গুরুত্ব প্রকাশিত হয়েছে।

৩. ব্যক্তিত্ব ও আত্ম-অভিব্যক্তি

রোমান্টিকতা ব্যক্তিত্ব এবং আত্ম-অভিব্যক্তির প্রতি একটি নতুন গুরুত্ব প্রদান করে। রোমান্টিক কবিরা তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং অভ্যন্তরীণ অনুভূতিগুলিকে প্রকাশের জন্য বিভিন্ন সাহিত্যিক রূপ গ্রহণ করেন। এটি তাঁদের কবিতার গভীরতা এবং মৌলিকতার একটি অংশ।

৪. সামাজিক বিদ্রোহ এবং বিপ্লব

রোমান্টিক আন্দোলন একটি সমাজবিরোধী এবং বিপ্লবী চিন্তা ধারণ করে। এটি সমাজের প্রচলিত নিয়ম-কানুন, শৃঙ্খলা এবং কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করে। বিশেষ করে ফ্রান্সের রোমান্টিক লেখকদের কাজগুলিতে এই বিদ্রোহী চিন্তা প্রাধান্য পায়।

৫. ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন

রোমান্টিকতাবাদ মধ্যযুগের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেছে। এটি পুরনো কল্পনার ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক বিষয়গুলিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এবং পুনরাবিষ্কৃত করার একটি প্রক্রিয়া। ভিক্টর হুগো ও ওয়াল্ট হুইটম্যানের কাজগুলি এই পুনরুজ্জীবনের প্রমাণ।

উপসংহার

রোমান্টিকতাবাদ একটি গভীর সাংস্কৃতিক এবং শিল্পগত আন্দোলন, যা মধ্যযুগের পূর্ণজাগরণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এর কেন্দ্রীয় লক্ষণগুলির মধ্যে প্রকৃতির সৌন্দর্য, কল্পনা ও অনুভূতির গুরুত্ব, ব্যক্তিত্ব এবং আত্ম-অভিব্যক্তি, সামাজিক বিদ্রোহ, এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন উল্লেখযোগ্য। এই আন্দোলন সাহিত্য এবং শিল্পের জগতে নতুন ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটায়, যা আজও প্রভাবিত করে।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading