লোকসভা এবং রাজ্যসভার মধ্যে সম্পর্ক (Relation between the House of the People and the Council of States)

লোকসভা এবং রাজ্যসভার মধ্যে সম্পর্ক

রাষ্ট্রপতি, লোকসভা এবং রাজ্যসভাকে নিয়ে ভারতের পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছে। পার্লামেন্ট হল দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। এর নিম্নকক্ষকে লোকসভা এবং উচ্চকক্ষকে রাজ্যসভা বলা হয়।

[১] গঠনগত এবং

[২] ক্ষমতাগত দিক থেকে উভয় কক্ষের সম্পর্ক বিচারবিশ্লেষণ করলে লোকসভা এবং রাজ্যসভার মধ্যে কতকগুলি পার্থক্য বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।

গঠনগত ক্ষেত্রে লোকসভা এবং রাজ্যসভার পার্থক্য:

[ক] সদস্যসংখ্যার ক্ষেত্রে পার্থক্য:  

লোকসভার সদস্যসংখ্যা রাজ্যসভার সদস্যসংখ্যা অপেক্ষা অনেক বেশি। রাজ্যসভা অনধিক ২৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতে পারে। কিন্তু লোকসভার সদস্যসংখ্যা সর্বাধিক ৫৫২ হতে পারে। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বিধানসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একক হস্তান্তরযোগ্য সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নিয়মানুযায়ী রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচন করেন। কিন্তু লোকসভার সদস্যরা সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণ কর্তৃক গোপন ভোটদান পদ্ধতিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন। তা ছাড়া, রাষ্ট্রপতি যেখানে সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজসেবা, চারুকলা প্রভৃতিতে পারদর্শী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ১২ জনকে রাজ্যসভায় মনোনীত করতে পারেন, সেখানে তিনি মাত্র ২ জন ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্যকে লোকসভায় মনোনীত করার অধিকারী।

[খ]যোগ্যতাগত ক্ষেত্রে পার্থক্য:

রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত বা মনোনীত হওয়ার জন্য প্রার্থীকে অন্যূন ৩০ বছর বয়স্ক হতে হয়; কিন্তু লোকসভার ক্ষেত্রে ২৫ বছর বয়স্ক হলেই চলে।

[গ]কার্যকাল-সংক্রান্ত পার্থক্য:

রাজ্যসভা পার্লামেন্টের স্থায়ী কক্ষ। রাষ্ট্রপতি এই কক্ষকে ভেঙে দিতে পারেন না। রাজ্যসভার সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ হল ৬ বছর। প্রতি ২ বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্যকে অবসর গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু লোকসভা পার্লামেন্টের স্থায়ী কক্ষ নয়। লোকসভার সাধারণ কার্যকালের মেয়াদ বর্তমানে ৫ বছর। এই কার্যকালের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে রাষ্ট্রপতি লোকসভা ভেঙে দিতে পারেন। আবার, জরুরি অবস্থার সময় লোকসভার মেয়াদ তিনি ১ বছর বৃদ্ধি করতে সক্ষম

ক্ষমতাগত ক্ষেত্রে পার্থক্য:

ক্ষমতা ও মর্যাদার দিক থেকে বিচার ক’রে উভয় কক্ষকে সম-ক্ষমতার অধিকারী বলে বর্ণনা করা যায় না। যদিও কোনো কোনো বিষয়ে রাজ্যসভা লোকসভার সমক্ষমতা ও মর্যাদার কিংবা অধিক ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী, তথাপি সার্বিক বিচারে রাজ্যসভা অপেক্ষা লোকসভার প্রাধান্য এবং শ্রেষ্ঠত্ব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। যাই হোক, লোকসভা এবং রাজ্যসভার মধ্যে ক্ষমতাগত পার্থক্যকে তিনটি দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে, যথা- [ক] কয়েকটি ক্ষেত্রে উভয় কক্ষ সমক্ষমতার অধিকারী; [খ] কয়েকটি ক্ষেত্রে লোকসভা অপেক্ষা রাজ্যসভা অধিক ক্ষমতার অধিকারী এবং [গ] কয়েকটি ক্ষেত্রে লোকসভা রাজ্যসভা অপেক্ষা অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী।

উভয় কক্ষ সমক্ষমতা সম্পন্ন:

[ক] যেসব বিষয়ে লোকসভা এবং রাজ্যসভা সমান ক্ষমতা ভোগ করে, সেগুলি হল-

 [i] অর্থবিল (Money Bill) ছাড়া অন্য সব বিলই পার্লামেন্টের যে-কোনো কক্ষে উত্থাপিত হতে পারে। ওইসব বিল পাসের ক্ষেত্রে লোকসভা এবং রাজ্যসভা সম- ক্ষমতার অধিকারী। যে-কক্ষে বিল উত্থাপিত হয়, সেই কক্ষে গৃহীত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিলটিকে অন্য কক্ষের সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়। শেষোক্ত কক্ষ বিলটি গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। বিলটি শেষোক্ত কস্তু কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলে তা আর আইনে পরিণত হয় না। কিন্তু উভয় কক্ষে গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য বিলটিকে তাঁর কাছে প্রেরণ করা হয়।

 [ii] সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষই সমান ক্ষমতার অধিকারী। যে-কোনো কক্ষ সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। উভয় কক্ষের সম্মতি ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা যায় না। ১৯৭০ সালে রাজন্যভাতা বিলোপ-সংক্রান্ত সংবধিান সংশোধনী বিলটি মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে রাজ্যসভায় প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। অনুরূপভাবে, ১৯৮৯ সালে ৬৩-তম ও ৬৪-তম সংবিধান সংশোধনী বিল দুটি রাজ্যসভা কর্তৃক সমর্থিত না হওয়ায় বাতিল হয়ে যায়।

 [iii] রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ও পদচ্যুতির ব্যাপারে উভয় কক্ষই সমান ক্ষমতা ভোগ করে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘নির্বাচক সংস্থা’র অংশ হিসেবে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের নির্বাচিত সদস্যরা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উপরাষ্ট্রপতিও পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে সংবিধানভঙ্গের অভিযোগ উত্থাপন ক’রে পার্লামেন্ট তাঁকে পদচ্যুত করতে পারে। তা ছাড়া, সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিবৃন্দ, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, মহাহিসাব নিয়ামক ও নিরীক্ষক প্রমুখকে পদচ্যুত করার জন্য পার্লামেন্ট প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারে।

[iv] পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ আইনসভার অবমাননা কিংবা অধিকারভঙ্গের অভিযোগে পার্লামেন্টের যে-কোনো সদস্য কিংবা সদস্য নন এমন ব্যক্তিকে শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে পারে।

 [v] রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর সংশ্লিষ্ট ঘোষণাটিকে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের কাছে পেশ করতে হয়। লোকসভা কর্তৃক অনুমোদিত হলেও রাজ্যসভার বিনা সম্মতিতে তা গৃহীত হতে পারে না।

[vi] কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পার্লামেন্ট হাইকোর্ট স্থাপন করতে কিংবা কোনো আদালতকে হাইকোর্টের মর্যাদায় উন্নীত করতে পারে। পার্লামেন্ট যে-কোনো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের হাইকোর্টের ক্ষমতার পরিধি সম্প্রসারণে সক্ষম।

রাজ্যসভার প্রাধান্য:

| [খ] কয়েকটি বিষয়ে রাজ্যসভা লোকসভা অপেক্ষা অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী। নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে রাজ্যসভার একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত-

[i] রাজ্যসভার উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে যদি এমন কোনো প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, জাতীয় স্বার্থে রাজ্য-তালিকাভুক্ত কোনো বিষয়ে পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন, তাহলে সেই বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করতে পারে [২৪৯(১) নং ধারা]। এইভাবে রাজ্যসভা প্রস্তাব গ্রহণ ক’রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অন্যতম অপরিহার্য বৈশিষ্ট ক্ষমতাবণ্টন ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনে সক্ষম।

[ii] উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রাজ্যসভা যদি এই প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, জাতীয় স্বার্থে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পার্লামেন্ট কর্তৃক বিচার বিভাগীয় কৃত্যক-সহ এক বা একাধিক সর্বভারতীয় কৃত্যক গঠন করা প্রয়োজন বা জরুরি, তাহলে পার্লামেন্ট তা করতে পারে নং 312(1) ধারা]।

 [iii] রাজ্যসভা এককভাবে উপরাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করার প্রস্তাব গ্রহণ করতে সক্ষম। তবে এরূপ প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য অন্তত ১৪ দিন পূর্বে নোটিশ দিতে হয় এবং সেই প্রস্তাবের সঙ্গে লোকসভা সহমত পোষণ করলে তা কার্যকর হতে পারে [৬৭ (খ) নং ধারা)।

লোকসভার প্রাধান্য:

[গ] যেসব বিষয়ে রাজ্যসভার পরিবর্তে লোকসভার প্রাধান্য-প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত, সেগুলি হল-

 [i] কোনো অর্থবিল রাজ্যসভায় উত্থাপিত হতে পারে না; কেবল লোকসভাতেই তা উত্থাপিত হতে পারে।

 [ii] কোনো বিল অর্থবিল কি না, তা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে লোকসভার অধ্যক্ষ (Speaker)-এর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। এ ব্যাপারে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের আদৌ কোনো ভূমিকা নেই।

 [iii] বাজেট নিয়ে রাজ্যসভা আলোচনা করতে পারলেও ব্যয়মঞ্জুরি দাবি, বিনিয়োগ বিল পাস ইত্যাদি ব্যাপারে লোকসভার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়।

 [iv] রাজ্যসভা কোনো অর্থবিলকে সংশোধন কিংবা বাতিল করতে পারে না।

[v] লোকসভা রাজ্যসভার সম্মতির জন্য অর্থবিল প্রেরণ করে। রাজ্যসভায় প্রেরিত হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে অর্থবিলকে লোকসভার কাছে ফেরত পাঠাতে হয়। এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থবিল লোকসভায় ফেরত না এলে বিলটি উভয় কক্ষে গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

 [vi] অর্থবিল-সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্যসভা কর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশ গ্রহণ করা বা না-করা লোকসভার সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন।

 [vii] অর্থবিল ছাড়া অন্য বিলের ক্ষেত্রে লোকসভা ও রাজ্যসভার মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হলে রাষ্ট্রপতি সেই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। এই অধিবেশনে লোকসভার অধ্যক্ষ সভাপতিত্ব করেন। যৌথ অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে বিলটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়। বলা বাহুল্য, লোকসভার সদস্যসংখ্যা রাজ্যসভার সদস্যসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ার শেষ পর্যন্ত লোকসভার মতামতই বলবৎ হয়।

» [viii] সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য মন্ত্রীসভা যৌথভাবে লোকসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকে।

লোকসভার আস্থাভাজন থাকলে মন্ত্রীসভাকে রাজ্যসভা কখনোই পদচ্যুত করতে পারে না। কারণ, মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের ক্ষমতা কেবল লোকসভারই রয়েছে।

উপসংহার:

উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েতের উভয় কক্ষ যেরূপ সমক্ষমতা ও সমমর্যাদার অধিকারী ছিল, ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সম্পর্ক সেরূপ নয়। আবার, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লর্ড সভার মতো ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ অর্থাৎ রাজ্যসভা যেমন একেবারে ক্ষমতাহীন নয়, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটের মতো তা শক্তিশালীও নয়।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading