শিমোনোসেকি চুক্তি এবং জাপানের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত নোট লিখুন।

শিমোনোসেকি চুক্তি এবং জাপানের উপর এর প্রভাব:

ভূমিকা:

শিমোনোসেকি চুক্তি, যা ১৮৯৫ সালে চীন ও জাপানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি ছিল, যা চীন-জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪-১৮৯৫)-এর সমাপ্তি ঘটায়। চুক্তিটি শিমোনোসেকি বন্দরে স্বাক্ষরিত হওয়ায় তার নামকরণ করা হয় এবং এর মাধ্যমে চীন পরাজিত হয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হারায়, যার মধ্যে কোরিয়া, তাইওয়ান, পেনহুই প্রভৃতি ছিল। এই চুক্তি শুধুমাত্র চীনের জন্য একটি বড় পরাজয় ছিল না, বরং এটি জাপানের আধুনিক বিশ্বে শক্তিশালী সামরিক এবং অর্থনৈতিক জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সঙ্গেও সম্পর্কিত ছিল। শিমোনোসেকি চুক্তির ফলে জাপান চীনের উপর একটি বৃহত্তর প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় এবং এটি দেশের সামরিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে এক নতুন যুগের সূচনা করে।

চুক্তির প্রধান শর্তাবলী:

শিমোনোসেকি চুক্তির বেশ কয়েকটি প্রধান শর্ত ছিল, যা চীন এবং জাপানের মধ্যে সংঘটিত চীন-জাপান যুদ্ধের ফলস্বরূপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল:

১. কোরিয়ার স্বাধীনতা: চীন কোরিয়াকে তার প্রদেশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং এটি ১৮৯৪ সালে যুদ্ধের শুরু থেকেই ছিল চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন। শিমোনোসেকি চুক্তির মাধ্যমে চীন কোরিয়াকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ফলে, কোরিয়া চীনের প্রভাব থেকে মুক্তি পায় এবং জাপান কোরিয়ায় প্রভাব প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায়।

২. তাইওয়ান এবং পেনহুই: চীনের প্রাদেশিক অঞ্চল তাইওয়ান এবং পেনহুই (Pescadores) দ্বীপপুঞ্জ জাপানকে দেওয়া হয়। এটি জাপানের জন্য একটি বড় অর্জন ছিল, কারণ এটি দক্ষিণ চীনের উপকূলে তার সামরিক এবং বাণিজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। তাইওয়ান জাপানের একটি উপনিবেশে পরিণত হয় এবং এটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জাপানের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৩. যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ: চীন যুদ্ধের জন্য জাপানকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২০০ মিলিয়ন মার্ক প্রদান করতে সম্মত হয়। এই অর্থ জাপানকে সামরিক ও আর্থিকভাবে শক্তিশালী করার সুযোগ দেয়।

৪. অধিকার এবং বাণিজ্যিক সুবিধা: চীন তার পোর্ট শহরগুলোর উপর জাপানের বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করতে সম্মত হয়। জাপান কিছু বন্দরকে খোলার জন্য এবং চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য অতিরিক্ত সুবিধা লাভ করে।

জাপানের উপর প্রভাব:

১. আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি: শিমোনোসেকি চুক্তি জাপানের আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং সামরিক শক্তির প্রদর্শন হিসেবে কাজ করে। এটি জাপানকে বিশ্বের শক্তিশালী জাতির তালিকায় স্থান দেয় এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর সামনে জাপানের অবস্থান দৃঢ় করে।

২. বিস্তৃত সাম্রাজ্যবাদী নীতি: চুক্তির মাধ্যমে জাপান প্রথমবারের মতো কোরিয়া, তাইওয়ান এবং অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি কার্যকরী করে। এটি জাপানের সাম্রাজ্যবাদের প্রাথমিক স্তরের সূচনা করে, যা পরে অন্যান্য এশীয় দেশগুলোতে বিস্তৃত হয়।

৩. অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি: চুক্তি অনুযায়ী জাপানকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করা হয়। এটি জাপানের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করে এবং তাদের শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।

৪. সামরিক শক্তির উন্নতি: চুক্তির পর, জাপান তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেয়। তাইওয়ান এবং পেনহুই দ্বীপের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, জাপান তার নৌবাহিনীর শক্তি বাড়াতে সক্ষম হয় এবং দক্ষিণ চীনে তার সামরিক উপস্থিতি শক্তিশালী করে।

৫. জাপানের আধিপত্যের সূচনা: শিমোনোসেকি চুক্তি জাপানের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করে, যেখানে তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। কোরিয়া, তাইওয়ান এবং অন্যান্য অঞ্চলে জাপানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ভবিষ্যতে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির পথ প্রশস্ত করে।

চীনের উপর প্রভাব:

১. চীনের দুর্বলতা প্রদর্শন: শিমোনোসেকি চুক্তির ফলে চীন তার শক্তি ও কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। কোরিয়া, তাইওয়ান এবং পেনহুই দ্বীপ চীনের কাছ থেকে চলে যাওয়া, চীনের সামরিক এবং রাজনৈতিক দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হয়।

২. আন্তর্জাতিক অপমান: চীনকে যুদ্ধের পরাজয়ের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে অপমানিত হতে হয়। এটি চীনের উপর পশ্চিমা শক্তিগুলোর চাপ বাড়ানোর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।

৩. ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিণতি: শিমোনোসেকি চুক্তির পর, চীন একটি দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিমা জাতির দ্বারা শোষিত ও দুর্বল হতে থাকে, যা তাদের পরবর্তী শতাব্দীর ইতিহাসে এক বিরাট প্রভাব ফেলে।

উপসংহার:

শিমোনোসেকি চুক্তি শুধুমাত্র চীন ও জাপানের মধ্যে একটি যুদ্ধের পরিণতি নয়, এটি ছিল জাপানের আধুনিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। চুক্তির মাধ্যমে জাপান কেবল এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়নি, বরং এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, চীনের জন্য চুক্তিটি ছিল একটি অপমানজনক পরাজয়, যা পরবর্তী সময়ে দেশটির রাজনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতার সূচনা করে। শিমোনোসেকি চুক্তির ফলে জাপান কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, পৃথিবীজুড়ে তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, যা এক নতুন সাম্রাজ্যবাদী যুগের সূচনা ঘটায়।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading