সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যবাদী নীতির মূল্যায়ন কর ?

সমুদ্রগুপ্তেরসাম্রাজ্যবাদীনীতি :


সমুদ্রগুপ্ত সম্পর্কিত ঐতিহাসিক উপাদান :-
যেসকল উপাদান থেকে সমুদ্রগুপ্ত এবং তাঁর সাম্ৰাজ্যবাদী নীতি সম্পর্কে জানা যায় , সেগুলি হল –
(i) হরিষেন কর্তৃক রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি।
(ii) মধ্যপ্রদেশে প্রাপ্ত এরাণ লিপি।
(iii) সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক প্রচারিত বিভিন্ন ধরণের পাঁচ প্রকার মুদ্রা।
(iv) চৈনিক বিবরণ।
(v) অন্যান্য মুদ্রা , বাগেলখন্ড শিলালিপি – ইত্যাদি।

সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্য :


মৌর্য পরবর্তী যুগে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। সমুদ্রগুপ্ত ভারতের এক বিরাট অংশ জয় করে ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তবে সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে। যেমন – ডক্টর রোমিলা থাপারের মতে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসারের জন্যই সমুদ্রগুপ্ত সাম্ৰাজ্যবিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। আবার ডক্টর গয়াল বলেছেন – সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ ভারতের বিপুল সম্পদ লুন্ঠন করা।
তবে , সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ থাকলেও তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলে যে সমগ্র ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল – সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন –
(A) উত্তরভারত বা আর্যাবর্ত বিজয়।
(B) দক্ষিণ ভারত বা দাক্ষিণাত্য জয়।
(C) আটবিক রাজ্য জয়।
(D) সীমান্তবর্তী রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান।
(E) অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি।
(A) উত্তরভারত বা আর্যাবর্ত বিজয় :-

সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারতের নয়জন রাজাকে পরাজিত করে তাদের সাম্রাজ্য নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। এই নয়জন রাজা হলেন –
১. অহিচ্ছত্র অধিপতি অচ্যুত।
২. মধ্য ভারতের নাগসেন।
৩. মথুরার নাগ বংশীয় রাজা গণপতিনাগ।
৪. বকাটক বংশীয় রুদ্রদেব।
৫. বুন্দেলশহরের মতিল।
৬. বিদিশার শাসক নাগদত্ত।
৭. গোকর্ণের শাসক চন্দ্রবর্মন।
৮. কামরূপের রাজা বলবর্মন।
৯. নাগবংশীয় রাজা নন্দীন।

উত্তর ভারতের এই নয়জন রাজাকে পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত তাদের রাজ্য নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এইভাবে সমগ্র আর্যাবর্ত তথা উত্তর উত্তর ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

দক্ষিণ ভারত বা দাক্ষিণাত্য জয় :


দক্ষিণ ভারতে তিনি মোট বারোটি রাজ্য জয় করেন। এই বারোটি রাজ্য হল – ১. কোশলের মহেন্দ্র , ২. মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ , ৩. কৌরলের মন্তরাজ , ৪. পিষ্ঠপুরমের মহেন্দ্রগিরি , ৫. কুস্থলপুরের ধনঞ্জয় , ৬. দেবরাষ্ট্রের কুবের , ৭. কোট্টুরের স্বামীদত্ত , ৮. পলাক্কের উগ্রসেন , ৯. এরণ্ডপল্লের দমন , ১০. অবমুক্তার নীলরাজ , ১১. কাঞ্চির বিষ্ণুগোপ , ১২. বেঙ্গির হস্তিবর্মন।
দক্ষিণ ভারতের এই বারোজন রাজাকে পরাজিত করলেও সমুদ্রগুপ্ত তাদের রাজ্যগুলিকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি। শুধুমাত্র কর গ্রহণ ও আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেই সমুদ্রগুপ্ত তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতিকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। এই রাজনৈতিক নীতির মাধ্যমে সমুদ্রগুপ্ত তাঁর অগাধ কূটনৈতিক দূরদৃষ্টিতার পরিচয় প্রদান করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে , সুদূর মগধ থেকে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব নয়। এই নীতি ” গ্রহণ – মোক্ষ – পরিগ্রহ ” নামে পরিচিত।

আটবিক রাজ্য জয় :


সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয়ের তৃতীয় স্তর ছিল আটবিক রাজ্যসমূহের বিরুদ্ধে অভিযান। দক্ষিণ ভারতে সেনা অভিযান করতে এই আটবিক রাজ্যসমূহকে জয় করার প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেন। আটবিক রাজ্যসমূহের অরণ্যময় অঞ্চলগুলিকে জয় করতে না পারলে দক্ষিণ ভারত অভিযানে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হত। তাই সমুদ্রগুপ্ত আটবিক রাজ্যসমূহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং আটবিক রাজ্যসমূহকে প্রায় সম্পূর্ণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনস্ত করে আটবিক নৃপতিদের দাসত্বে পরিণত করেন।

সীমান্তবর্তী রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান ও তাঁদের আনুগত্যলাভ :-


সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয়ে আতঙ্কিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি রাজ্য এবং তাদের রাজারা বিনাশর্তে সমুদ্রগুপ্তের আনুগত্য স্বীকার করেন। সমতট , কামরূপ , নেপাল , দাভক ও কর্তৃপুর – এই পাঁচটি সীমান্তবর্তী রাজ্য সমুদ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করেন। এছাড়াও সমগ্র ভারতের প্রায় নয়টি উপজাতি শাসিত রাজ্যগুলিও সমুদ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করেন। এই উপজাতি শাসিত রাজ্যগুলি হল – মালব , অর্জুনায়ন , মদ্রক , প্ৰাৰ্জুন , কাক – ইত্যাদি।

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি :-


উপরোক্ত রাজ্যগুলি ছাড়াও বেশ কিছু রাজ্য সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিতে আবদ্ধ হন। এই সকল রাজ্যগুলি হল – সিংহলরাজ মেঘবর্ণ , মালবরাজ , কাথিয়াওয়ারের শক শাসক , সুমাত্রা , মালয় ও যবদ্বীপের শাসক। এছাড়াও পশ্চিম পাঞ্জাব ও আফগানিস্তানের কুষাণ শাসক পারসিক আক্রমণে ভীত হয়ে সমুদ্রগুপ্তের সাহায্য প্রার্থনা করেন।

সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের বিস্তার :


উপরোক্ত পাঁচটি দিগ্বিজয় নীতি অনুসরণ করে সমুদ্রগুপ্ত এক বিরাট সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর দ্বারা ভারত একটি অখন্ড সাম্রাজ্যে পরিণত হয় ও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যসীমা উত্তরে কাশ্মীর ; পশ্চিমে পশ্চিম পাঞ্জাব , রাজপুতানা , সিন্ধু ও গুজরাট ; পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ , দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। এছাড়াও ছিল বহুসংখ্যক করদ রাজ্য , অনুগত রাজ্য মিত্র রাজ্য। সমুদ্রগুপ্তের সফল দিগ্বিজয় নীতির কারণে ঐতিহাসিক স্মিথ সমুদ্রগুপ্তকে ‘ ভারতের নেপোলিয়ন ‘ বলে অভিহিত করেছেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading